স্বপ্না শিমু স্টাফ রিপোর্টার
তিউনিসিয়ায় পুলিশের হয়রানি ও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার প্রতিবাদে ১৫ বছর আগে নিজের গায়ে আগুন দিয়েছিলেন রাস্তার পাশের সাধারণ একজন বিক্রেতা, ২৬ বছর বয়সি মোহাম্মদ বুয়াজিজি।
পুলিশের হাতে নিজের ঠেলাগাড়ি জব্দ হওয়ার পর হতাশা থেকেই চরম এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কে জানত, সেই আগুনের তাপেই বদলে যাবে পুরো অঞ্চলের রাজনীতি!
মোহাম্মদ বুয়াজিজির এই ‘আত্মদাহ’ তিউনিসিয়াজুড়ে গণবিক্ষোভের সূচনা করে। বেকারত্ব, দুর্নীতি এবং দশকের পর দশক ধরে চলা দমনমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসে লাখো মানুষ। মাত্র ২৮ দিনের মধ্যেই ২৩ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট জাইন আল-আবিদিন বেন আলীকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেন বিক্ষোভকারীরা।
তিউনিসিয়ার এই আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১১ সালে মিশর, লিবিয়া, ইয়েমেন ও সিরিয়াতেও আন্দোলন-বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সেই আন্দোলনই পরে ‘আরব বসন্ত’ নামে পরিচিত হয়, যার ফলে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা পাঁচজন শাসকের পতন ঘটে।
এই নেতাদের পরিণতি কী হয়েছিল– বিস্তারিত এক প্রতিবেদনে সেই তথ্য তুলে ধরেছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
তিউনিসিয়া: জাইন আল-আবিদিন বেন আলী
১৯৮৭ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, ‘প্রেসিডেন্ট-ফর-লাইফ’ হাবিব বুরগিবাকে ‘শাসনের জন্য চিকিৎসাগতভাবে অযোগ্য’ ঘোষণা করেন বেন আলী। নিরাপত্তা বাহিনী ও অনুগত রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভর করে গড়ে তোলেন এক কঠোর শাসনব্যবস্থা।
অর্থনীতি উন্মুক্ত করা হলেও দেশটি দুর্নীতি, বৈষম্য ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে জড়িয়ে পড়ে।
এরপর, ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর মোহাম্মদ বুয়াজিজির আত্মদাহের পর দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। টানা এক মাসের বিক্ষোভের পর ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি বেন আলী সরকার ভেঙে দিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং সৌদি আরবে পালিয়ে যান।
পরবর্তীতে তিউনিসিয়ার আদালত তাকে (অনুপস্থিতিতে) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। তবে সেই সাজা ভোগ করতে হয়নি বেন আলীর। ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের জেদ্দায় নির্বাসনে থাকা অবস্থায় ৮৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
মিশর: হোসনি মোবারক
১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাত হত্যাকাণ্ডের পর মিশরের প্রেসিডেন্ট হন হোসনি মোবারক।
সামরিক আধিপত্য এবং জরুরি আইনের মিশ্রণের মাধ্যমে ক্ষমতা সুসংহত করেছিলেন দেশটির বিমান বাহিনীর সাবেক এই কমান্ডার। ভিন্নমতের ওপর দমন-পীড়ন, সীমিত রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং ব্যাপক দুর্নীতির মাধ্যমে কঠোর শাসন বজায় রেখেছিলেন তিনি।
কিন্তু ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি পুলিশ দিবসে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসেন আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটির বিক্ষোভকারীরা। মোবারকের পদত্যাগের দাবি তোলেন তারা।
১৮ দিনের বিক্ষোভের পর, ২০১১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তিন দশকের প্রেসিডেন্সির অবসান ঘটিয়ে মোবারক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বিপ্লবের সময় শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে মোবারককে বিচারের মুখোমুখি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এবং পরে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।
কিন্তু, দেশের উচ্চ আদালত এই সাজা বাতিল করে দেন এবং পুনর্বিচারের আদেশ দেয়া হয়।
সেই পুনর্বিচার প্রক্রিয়া চলাকালীন, হোসনি মোবারককে দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং আটকে রাখা হয়েছিল ছয় বছর। যদিও স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক দৃশ্যপটের কারণে, নির্ধারিত সময়ের খুব কমই তাকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে।
২০১৭ সালে তিনি খালাস এবং মুক্তি পান। ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ৯১ বছর বয়সে কায়রোতে মারা যান হোসনি মোবারক।
ইয়েমেন: আলী আবদুল্লাহ সালেহ
৩৩ বছর ধরে ইয়েমেন শাসন করেছেন আলী আবদুল্লাহ সালেহ। প্রথমে ১৯৭৮ সাল থেকে উত্তর ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এবং তারপর ১৯৯০ সাল থেকে ইউনিফায়েড ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে।
উপজাতি ও সামরিক রাজনীতির একজন মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত ছিলেন সালেহ। একসময় ইয়েমেন শাসন করাকে ‘সাপের মাথায় নৃত্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন সালেহ, যেখানে তিনি এই অঞ্চলে পরিবর্তনশীল জোটগুলোকে কাজে লাগাতেন।
২০১১ সালে আরব বসন্তের বিক্ষোভের পর, ২০১২ সালে ক্ষমতা হস্তান্তর চুক্তির আওতায় সালেহকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়।
তবে এর পরপরই তিনি তার আগের ‘শত্রু’ হুতিদের সাথে একটি জোট গড়ে তোলেন, যা ২০১৪ সালে তাদের রাজধানী সানা দখল করতে সাহায্য করে।
যদিও ২০১৭ সালে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করলে হুতিরাই তাকে হত্যা করে। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৭৫ বছর।
লিবিয়া: মুয়াম্মার গাদ্দাফি
মুয়াম্মার গাদ্দাফি ছিলেন একজন সেনা কর্মকর্তা, যিনি ১৯৬৯ সালের এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। পরে তিনি লিবিয়ার রাজতন্ত্র ভেঙে দেন এবং নিজেকে কর্নেল পদে উন্নীত করেন, যা বাকি জীবন ধরে ধরে রেখেছিলেন।
অত্যন্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক, নিয়ন্ত্রণমূলক একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন গাদ্দাফি। আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে তিনি শাসন পরিচালনা করতেন বিপ্লবী কমিটির মাধ্যমে এবং লিবিয়ার বিশাল তেল সম্পদের কৌশলগত ব্যবহারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতেন।
কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকলেও, ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে পারমাণবিক, রাসায়নিক এবং জৈবিক অস্ত্র কর্মসূচি ত্যাগ করার পর তিনি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সাথে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন করেন।
২০১১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একজন মানবাধিকার আইনজীবীকে গ্রেফতারের পর বেনগাজিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। অন্যান্য আরব বসন্তের দেশের মতো, এই ঘটনাটিও একটি অনুঘটক ছিল; তবে, গাদ্দাফির সহিংস দমন-পীড়ন শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে পূর্ণাঙ্গ সশস্ত্র বিদ্রোহ এবং গৃহযুদ্ধে রূপ দেয়।
এরপর ন্যাটোর সহায়তায় একই বছরের আগস্টের মধ্যে বিদ্রোহীরা ত্রিপোলি দখল করে। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর নিজ শহরে পালানোর সময় বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ে নিহত হন গাদ্দাফি, যার ফলে তার ৪২ বছরের ক্ষমতার অবসান ঘটে।
Sharing is caring!