লোকমান ফারুক, রংপুর
বিকেলের নরম আলো তখন রংপুর নির্বাচন অফিসের বারান্দায়। ব্যস্ততার ভিড়ের মধ্যেও একজন মানুষ আলাদা করে চোখে পড়ছিলেন—শাড়ির আঁচল সামলে, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, মুখে দৃঢ়তার ছাপ। নাম তাঁর আনোয়ারা ইসলাম রানী। পরিচয়—তৃতীয় লিঙ্গ। রাজনীতির ভাষায়—স্বতন্ত্র প্রার্থী। আবারও ভোটের মাঠে।
বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) বিকেলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর-৩ (সদর) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন রানী।
কাগজপত্র হাতে নেওয়ার মুহূর্তটি ছিল নীরব কিন্তু অর্থবহ—যেন দীর্ঘদিন অবহেলায় চেপে রাখা একটি প্রশ্ন হঠাৎ প্রকাশ্যে এসে দাঁড়াল: এই রাষ্ট্রে প্রতিনিধিত্বের অধিকার আসলে কার?
রানীর রাজনীতিতে প্রবেশ নতুন নয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এই একই আসনে তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন। প্রতীক ছিল ঈগল। প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের।
সেই নির্বাচনে রানীর প্রাপ্ত ভোট—২৩ হাজার ৩৩৯। সংখ্যাটি শুধু ভোটের হিসাব নয়, এটি ছিল সমাজের এক প্রান্তিক কণ্ঠের দৃশ্যমান উপস্থিতি।
মনোনয়ন সংগ্রহের পর রানী বলেন, “কোনো ক্ষমতার জোরে নয়, কোনো দলের ছায়ায় নয়—মানুষের ভালোবাসা, বিশ্বাস আর ন্যায়ের শক্তিই আমার সম্বল।”
কথাগুলোতে কোনো অলংকার ছিল না, ছিল অভিজ্ঞতার ভার। রাজনীতিকে তিনি দেখেন সুবিধাভোগের পথ হিসেবে নয়, বরং দায়িত্বের জায়গা হিসেবে। “আমি এসেছি মানুষের কথা বলার জন্য, অবহেলিত কণ্ঠের ভাষা হতে, বলেন তিনি।
রানীর জীবনে প্রচলিত অর্থে ‘পিছুটান’ নেই। সংসার নেই, উত্তরাধিকার নেই। আছে সময়, আছে জেদ। সেই জেদ থেকেই তাঁর উচ্চারণ—’আমার পুরো সময়, শক্তি আর দায়বদ্ধতা আমি আপনাদের জন্য দিতে চাই।
প্রশ্ন জাগে, রাজনীতির মাঠে যাঁরা সবকিছু থাকার পরও সময় দিতে পারেন না, তাঁদের পাশে এই উচ্চারণ কোথায় দাঁড়ায়?
রংপুর-৩ আসনের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতা, দল আর পরিচিত মুখের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেখানে রানীর উপস্থিতি এক ধরনের বৈপরীত্য তৈরি করে। তিনি বলেন, এই লড়াই ব্যক্তিগত নয়।
এটি একটি মানবিক দায়, একটি ন্যায়ের আন্দোলন। কৃষক, শ্রমিক, নারী, তরুণ, বয়স্ক, সংখ্যালঘু—সবাই তাঁর ভাষায় একই বাক্যে এসে দাঁড়ায়। এখানেই তাঁর রাজনীতির ভিন্নতা।
রংপুর সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শোয়েব সিদ্দিকী জানান, তৃতীয় লিঙ্গের আনোয়ারা ইসলাম রানী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৯ ডিসেম্বর। তথ্যটি প্রশাসনিক, কিন্তু এর ভেতরেই লুকিয়ে আছে একটি সামাজিক বাস্তবতা—রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রান্তিক পরিচয়।
Sharing is caring!