ডেস্ক রিপোর্ট, রংপুর
রংপুরের উত্তর-পশ্চিমের শান্ত, ঘুমিয়ে থাকা একটি গ্রাম—তারাগঞ্জের কুর্শা ইউনিয়নের উত্তর রহিমাপুর। শনিবার দিবাগত রাতের কোনো এক গভীর মুহূর্তে সেই নীরবতা ছিন্ন হয়েছে দু’টি নিঃশব্দ হত্যার মাধ্যমে। ভোরের আলো ফুটতেই প্রকাশ্যে আসে এক ভয়াবহ দৃশ্য—নিজ বাড়িতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন মুক্তিযোদ্ধা যোগেশ চন্দ্র রায় (৭৫) ও তার স্ত্রী সুর্বণা রায় (৬০)।
রবিবার সকাল সাড়ে ৭টার পর প্রথম সন্দেহ হয় প্রতিবেশীদের। প্রতিদিনকার মতো ডাকাডাকি, কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই। ঘরটি অস্বাভাবিকভাবে নিশ্চুপ। অভ্যস্ত রুটিন ভঙ্গ হলে মানুষের মনেও ছায়া নামে—অস্থিরতার।
অবশেষে মই বেয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকেন প্রতিবেশী দীপক চন্দ্র রায়। হাতে পাওয়া চাবি দিয়ে প্রধান দরজা খুলতেই যেন সবকিছু থমকে যায়। ডাইনিং রুমের মেঝেতে যোগেশ রায়ের নিথর দেহ—মাথায় ভারী আঘাতের চিহ্ন। কয়েক কদম দূরে রান্নাঘরে পড়ে আছেন তার স্ত্রী সুর্বণা রায়, একইরকম নির্মম পরিণতিতে। দীপকের কণ্ঠ ভারী ছিল স্মৃতি ও আতঙ্কে।
‘৪০-৫০ বছর ধরে আমরা এই বাড়ির দেখাশোনা করি,’ বলেন তিনি। ‘রোজ সকালেই যাই। আজ ঘর বন্ধ দেখে বুঝলাম কিছু একটা ঠিক নেই। ভিতরে ঢোকার পর… আর কিছু দেখার মতো ছিল না।’
গ্রামবাসীর মধ্যে যোগেশ চন্দ্র রায়ের পরিচয় শুধু একজন শিক্ষক বা মুক্তিযোদ্ধার নয়—তিনি যেন সময়ের সাক্ষী, এক মূল্যবোধের প্রতীক। ২০১৭ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদ থেকে অবসর নেন তিনি।
দুই ছেলে—একজন জয়পুরহাটে চাকরি করেন, অন্যজন ঢাকায় পুলিশে কর্মরত। বহু বছর ধরে দম্পতি দুজন একাই গ্রামে থাকতেন। ঘটনার খবর রটে যাওয়ার পর সকাল দশটার দিকে এলাকায় নেমে আসে শোকের চাপা ঢেউ।
আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ছুটে আসে। ঘটনাস্থলে পৌঁছান পুলিশের তদন্তকারী দল, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোনাব্বর হোসেন এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলী হোসেন।
মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের ভাষায় শোকের পাশাপাশি ছিল ক্ষোভও—’২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। তা না হলে কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো।’ তারাগঞ্জ থানার এসআই মো. আবু ছাইয়ুম ঘটনাস্থল ঘুরে দেখার পর জানান, প্রাথমিক ধারণা—দুজনকেই মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে।
‘আমরা সব দিক খতিয়ে দেখছি। কেন, কীভাবে—ঘটনার রহস্য উদঘাটন আমাদের অগ্রাধিকার,’ বলেন তিনি। একটি বাড়ির দরজার নীরবতা, একটি গ্রামের দৃষ্টির শূন্যতা এবং দু’টি জীবনের রক্তাক্ত সমাপ্তি—এই হত্যাকাণ্ড শুধু অপরাধের ঘটনা নয়, নৈতিক প্রশ্নও তোলে। কে এই দুই প্রবীণ মানুষকে লক্ষ্য করল? কেন এই নিষ্ঠুরতা?
উত্তর রহিমাপুরের ভোরের আলোয় ছড়িয়ে থাকা সেই প্রশ্নগুলোই এখন তদন্তের অপেক্ষায়।
আর গ্রামের মানুষ তাকিয়ে আছে—ন্যায়ের দিকে, এবং সেই নীরব বাড়িটির বন্ধ দরজার দিকে, যেখান থেকে একসময় প্রতিদিন জীবন বের হতো, আর আজ সেখানে শোকের ভারী ছায়া।
Sharing is caring!