লোকমান ফারুক, রংপুর
বিকেলের আলো তখন ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে শীতল বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে ব্যানারে কাপড়ের মৃদু শব্দ। একাডেমিক ভবনের দেয়ালে ঝুলে পড়ছে নতুন নাম—নতুন ইতিহাস। ইট, সিমেন্ট আর কংক্রিটের গায়ে সেদিন শুধু নাম লেখা হয়নি; লেখা হয়েছে প্রতিরোধ, প্রতিবাদ আর আত্মত্যাগের এক অনিবার্য দলিল।
সোমবার (২২ ডিসেম্বর) বিকেলে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) আধিপত্যবাদবিরোধী দুই শহীদ—শরীফ ওসমান হাদি ও আবরার ফাহাদের নামে দুটি একাডেমিক ভবনের নামকরণ ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। একাডেমিক ভবন–৩ নতুন করে নাম পায় ‘শহীদ শরীফ ওসমান হাদি ভবন’, আর একাডেমিক ভবন–২ হয়ে ওঠে ‘শহীদ আবরার ফাহাদ একাডেমিক ভবন’। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ভবন দুটিতে টানানো হয় ব্যানার—নীরব কিন্তু উচ্চকণ্ঠ এক প্রতিবাদ।
এই আয়োজনের পেছনে কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না, ছিল না ক্ষমতার অনুমোদনের ছাপ। ছিল শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত স্মৃতি আর দায়বদ্ধতা—যা ইতিহাসকে ভুলে থাকতে দেয় না।
একাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী আহমাদুল হক আলবীর দাঁড়িয়ে বলেন,
“বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ডিগ্রি অর্জনের জায়গা নয়। এখান থেকেই ন্যায়, প্রতিবাদ আর মানবিকতার শিক্ষা সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের নামকরণের মধ্য দিয়ে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সেই শিক্ষাটাই রেখে যেতে চেয়েছি।” তার কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা, কিন্তু ভাষায় কোনো উচ্ছ্বাস নয়—বরং দায়িত্বের ভার।
জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নেজাজ আহমেদ ভিন্ন এক সময়রেখা টানেন। তিনি বলেন, “আজ থেকে বিশ কিংবা ত্রিশ বছর পর, যারা এই বিপ্লব দেখেনি, তারা যখন এই ক্যাম্পাসে আসবে—এই ভবনগুলোর নামই তাদের প্রশ্ন করতে বাধ্য করবে। জানতে চাইবে, কেন এই নাম? কী ঘটেছিল?” সেই প্রশ্নই হয়তো ইতিহাসের দরজা খুলে দেবে—বিদেশি আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে কীভাবে জীবন দিতে হয়েছিল তরুণদের।
অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে বলেন,” শহীদ আবরার ফাহাদ ও শহীদ শরীফ ওসমান হাদি—দুজনই ভারতীয় আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের সংগ্রামের চেতনা আজ কেবল ব্যক্তি বা সংগঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; তা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো জাতির মধ্যে। সেই চেতনাকে স্থায়ী করতেই এই উদ্যোগ।” এই উদ্যোগের পেছনে যে ইতিহাস, তা রক্তাক্ত এবং অস্বস্তিকর।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলে নির্মম নির্যাতনে প্রাণ হারান শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। অন্যদিকে, চলতি বছরের ১২ ডিসেম্বর ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দুজনের মৃত্যু আলাদা সময়ের, আলাদা প্রেক্ষাপটের—কিন্তু প্রশ্ন একটাই: রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও প্রতিবাদের সম্পর্ক কোথায় গিয়ে থামে?
বেরোবির শিক্ষার্থীরা সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন স্মৃতির ভেতর, ইটের গায়ে নাম লিখে। এখানে কোনো মূর্তি নেই, নেই পাথরের ফলক—আছে দৈনন্দিন চলাচলের ভেতর ঢুকে পড়া এক স্থায়ী স্মরণ। প্রতিদিনের ক্লাস, পরীক্ষা আর ব্যস্ততার মাঝেই শিক্ষার্থীরা উচ্চারণ করবে এই নাম—অজান্তেই বহন করবে ইতিহাসের ভার।
দিন শেষে ক্যাম্পাসে আলো নিভে এলে ব্যানারগুলো হয়তো অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে। কিন্তু নামগুলো থেকে যাবে। প্রশ্নগুলো থেকে যাবে। আর সেই প্রশ্নই হয়তো একদিন আবার কাউকে দাঁড় করাবে—ক্ষমতার বিপরীতে, সত্যের পক্ষে।
ইট–সিমেন্টের ভবন তখন আর কেবল ভবন থাকে না।
সেগুলো হয়ে ওঠে সময়ের সাক্ষ্য।
Sharing is caring!