১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১লা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৫শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

দুর্নীতি প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলনের আহ্বান

admin
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৯, ২০২৫, ১০:০০ অপরাহ্ণ
দুর্নীতি প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলনের আহ্বান

Manual5 Ad Code

লোকমান ফারুক, রংপুর

Manual3 Ad Code

ভোরের কাঁচা আলো যখন রংপুর শহরের পুরোনো রাস্তাগুলোকে ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছিল, টাউন হল চত্বর-সংলগ্ন সড়কে তখন এক দমকা শীতের হাওয়ার ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল নীরব এক সারি মানুষ। তাঁরা শুধু মানববন্ধনের অংশ নন—একটি অদেখা লড়াইয়ের প্রথম সারির সৈনিক।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে এই অবস্থান যেন এক ধরনের দৃশ্যমান বার্তা: অন্যায় ও অস্বচ্ছতার বিরুদ্ধে কেউ না কেউ দাঁড়াতে শুরু করেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের চোখে ভর করেই যেন শুরু হয় মূল গল্পটি—একটি সমাজ কীভাবে তার নিজের ভেতরের ক্ষয়কে চিনতে পারে, আর ঠিক কোন মুহূর্তে উঠে দাঁড়ায় বদলের জন্য।

মঙ্গলবার সকালে রংপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমির মিলনায়তনে যখন আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসের আলোচনা সভা শুরু হয়, হলঘরের দেয়ালগুলো যেন শুনছিল বহুদিনের জমা নীরবতা। বিভাগীয় কমিশনার মো. শহিদুল ইসলামের কণ্ঠে সে নীরবতার ভাঙন—’দুর্নীতি শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি বৈশ্বিক ক্ষত।’

একটু থেমে তিনি যেন হলঘরের দিকে তাকালেন—সেই দৃষ্টিতে ছিল একটি অঘোষিত প্রশ্ন। ‘আমরা কি আরও নীরব থাকব?’ তিনি বললেন, ‘পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই প্রতিরোধ শুরু হলে সমাজে ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত হবে।’

তাঁর কথায় দৃঢ়তা যেমন ছিল, তেমনি ছিল এক ধরনের সতর্ক ধ্বনি: যদি আজ না দাঁড়াই, আগামীর সমাজ আরও অন্ধকার হতে পারে। এ বছরের প্রতিপাদ্য—‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারুণ্যের একতা: গড়বে আগামীর শুদ্ধতা’।পুরো আলোচনায় যেন প্রতিপাদ্যের এই বাক্যটি নীরব লাল রেখার মতো ছড়িয়ে ছিল।

Manual5 Ad Code

সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল আহসান যখন বললেন, ‘দুর্নীতি একটি বহুমাত্রিক ও জটিল সমস্যা, যা উন্নয়নের মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে,’ তখন তাঁর কণ্ঠে শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল মাঠ প্রশাসনে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ক্লান্তি।

তারপরই যুক্ত করলেন তরুণদের প্রসঙ্গ—’ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তাদের হাতেই। তারা নৈতিকতা দিয়ে প্রশাসনকে আরও শক্তিশালী করবে।’ এ যেন শুধুই বক্তব্য নয়; বরং প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভেতর থেকে একটি নৈতিক SOS বার্তা। তিনি উল্লেখ করলেন, অনলাইন সেবা, জিআরএস অভিযোগ ব্যবস্থাপনা, শুদ্ধাচারের প্রয়োগ—যেন প্রমাণ দিতে চান, বদলের সূচনা অসম্ভব নয়, যদি সবাই নিজের অংশের কাজটি করে।

পুলিশ কমিশনার মো. মজিদ আলী, রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ের অতিরিক্ত ডিআইজি ড. আ.ক.ম আকতারুজ্জামান বসুনিয়া, দুদকের পরিচালক মোহা: নুরুল হুদা—প্রতিটি বক্তব্যেই যেন একটি অদৃশ্য সুতায় বাঁধা বার্তা ছিল: স্বচ্ছতার অভাব মানেই নিরাপত্তাহীনতা। সনাকের সভাপতি ড. শাশ্বত ভট্টাচার্য এবং জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ড. নাসিমা আকতারের বক্তব্যে উঠে আসে নাগরিক সমাজের অবস্থান—’দুর্নীতি যখন নিয়মে পরিণত হয়, তখন প্রতিরোধই হয়ে ওঠে প্রকৃত নাগরিকত্ব।’

Manual4 Ad Code

হলঘরের ভেতরে বাতাস তখন আর কেবলমাত্র বক্তব্যের শব্দে ভারী ছিল না; যেন প্রতিটি শব্দ হয়ে উঠছিল প্রশ্ন— কাদের জন্য এই লড়াই, আর কাদের কারণে? আলোচনা সভা যখন শেষ হলো, বাইরে তখনও মানববন্ধনের ব্যানারে শীতের হাওয়া লেগে কাঁপছে। যেন সেই কাঁপুনি শুধু কাপড়ের নয়—সমাজের বিবেকেরও। যেদিকে তাকানো যায়, চোখে পড়ছিল তরুণদের উপস্থিতি।

Manual7 Ad Code

তাদের মুখে অনিশ্চয়তা নেই; আছে এক ধরনের তীক্ষ্ণ প্রত্যয়। সমাপ্তির মুহূর্তে মনে হলো দিনের শুরুতে টাউন হল চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই নীরব সারি—আসলে তারা এই গল্পের সূচনাও, সমাপ্তিও। যেন প্রতিটি মানুষ বলছিল—দুর্নীতি থামানোর কাজটি দূরে নয়, এখানেই শুরু। আমাদের ভেতরেই। এই শহরের প্রতিটি সরকারি দপ্তর, প্রতিটি ফাইল, প্রতিটি স্বাক্ষরে জমে থাকা দীর্ঘ দিনের অভিযোগ যেন আজ মিলনায়তনের বাতাসে ভেসে ওঠে।

প্রশ্নটি ঘুরে ফিরে আসে: স্বচ্ছতা কি শুধু নথির শব্দ, নাকি মানুষের চরিত্র? আর ঠিক সেখানেই এই দিবসের তাৎপর্য—প্রশাসন, রাজনীতি ও নাগরিকতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে নৈতিকতার পুনরুদ্ধার।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code