ডেস্ক রিপোর্ট রংপুর
ভোরের কুয়াশা ভেদ করে যখন সূর্যের আলো ছুঁয়ে যায়, রংপুরের মিঠাপুকুরের কলা বাগানগুলোতে তখন গাছের পাতায় ঝরঝরে শিশির। এক এক করে কৃষকেরা কাঁধে কলার ছড়ি তুলে নিচ্ছেন—যেন এক টুকরো সবুজ সোনা।
কিন্তু সেই সোনার মূল্য আজ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। দূর্গাপুর গ্রামের কৃষক সোলাইমানের মুখে ক্লান্ত হাসি, কণ্ঠে দীর্ঘশ্বাস—’একমাস আগেও প্রতি ছড়ি কলা বিক্রি হতো সাতশো টাকা। এখন চারশো পেলেই ভাগ্য খুলে যায়।’
পাশে বসে থাকা আব্দুর রউফ আর লোকমান হোসেন মাথা নেড়ে বলেন, ‘হিসাব মেলাতে গেলে মনে হয়, চাষ করে লোকসানের ফাঁদেই পড়েছি।’ একসময় রংপুরের গ্রামগুলোতে সাগর কলা মানেই ছিল উৎসবের রঙ। এখন সেটাই যেন দুঃস্বপ্নের মতো ফিরে আসে। কলার দাম পড়েছে অর্ধেকে, অথচ সার, কীটনাশক আর শ্রম খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ।
পীরগাছার অন্নদানগরের চাষি মেরিন আহমেদ বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে আশা ছিল ভালো দাম পাবো। কিন্তু এখন বাজার দরে এমন ধস যে, মনে হয় ঘরে কলা রাখার জায়গা কম, আর বাজারে ন্যায্য দাম নেই।’ তার পাশে থাকা খাইরুল ইসলাম যোগ করলেন, ‘কাজ করছি মাঠে, কিন্তু লাভ যাচ্ছে অন্যের ঘরে।’ ইটাকুমারীর কালীগঞ্জে দাঁড়িয়ে গৌরাঙ্গ মোহন্তের হাত ঘামে ভেজা।
বললেন,’আমরা যারা সারাদিন মাটিতে ঘাম ঝরাই, তারা এখন শুধু চাই—একটু সুবিচার। সার আর কীটনাশকের দাম যদি একটু কমত, তাহলে বাঁচতাম।’
কৃষি অফিসার আনসার আলী অবশ্য আশার কথা শুনালেন-‘এই বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাম্পার ফলন হয়েছে। এখন দর ঠিক থাকলেই চাষির মুখে হাসি ফুটবে,’ বলেন তিনি। কিন্তু সেই হাসি এখন আটকে আছে রাজধানী ঢাকার ট্রাকের চাকার নিচে।
পীরগাছার আমপাইকর এলাকার ব্যবসায়ী সাদেল মিয়া বলেন, ‘রংপুরের সাগর কলা যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা—সবখানে। কিন্তু পরিবহন খরচ এত বেড়েছে যে, দাম পড়ছে চাষির ঘাড়ে ।
শহরে খাওয়ার সময় ভোক্তা চড়া দাম দেয়, অথচ চাষি পায় না তার এক ভাগও।’ রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা—সব জায়গায় কলার বাম্পার ফলন হয়েছে। অথচ মাঠের মানুষরা এখনও খুঁজে ফিরছে ন্যায্য বাজারদর। বিকেলের আলো নামতে থাকে। সোলাইমানের ছেলে রফিক কলার গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে জমির দিকে।
হয়তো ভাবছে, আগামী মৌসুমে আবার বীজ ফেলবে কি না। কলার পাতার ফাঁকে সূর্য অস্ত যায়—যেন চাষির চোখের আশাও ধীরে ধীরে নিভে আসে। কিন্তু গ্রামবাংলার মাটির মতোই এদের মনও স্থিতধী। তারা জানে, মাটির বুকেই লুকিয়ে আছে আগামী দিনের প্রেরণা।
একদিন হয়তো ন্যায্য দাম ফিরে আসবে, সোনালি কলার ছড়ি আবার হয়ে উঠবে আশার প্রতীক। রংপুরের কলা চাষির গল্প তাই কেবল এক মৌসুমের বাজার-দর নয়; এটা এক প্রজন্মের লড়াই—যেখানে ঘাম, কষ্ট, আর আশার রেখা মিলে তৈরি হয় জীবন নামের অনন্ত বাগান।
Sharing is caring!