লোকমান ফারুক, রংপুর
রংপুরের তারাগঞ্জের শান্ত, নির্জন হিন্দু পল্লী—পূর্ব রহিমাপুরের চাকলা শ্মশানে সোমবার বিকেলের আলো নিভে এসেছিল একটু তাড়াতাড়িই। সেই আলো-ছায়ার প্রান্তরেই শেষবারের মতো আগুনে মিলিয়ে গেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা যোগেশ চন্দ্র রায় (৭৫) ও তাঁর স্ত্রী সুবর্ণা রায় (৬৮)। একটি দম্পতির নিঃশব্দ জীবন, আরেকটি দীর্ঘ নীরব রাত—ফলাফল: ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড।
বিজয়ের মাসে এমন মৃত্যু, স্থানীয়দের চোখে তীব্র অপমানের মতো। সৎকারের আগে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোনাব্বর হোসেন ও তারাগঞ্জ থানার ওসি রুহুল আমিনের উপস্থিতিতে যোগেশ চন্দ্রের মরদেহে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। আকাশ মেঘলা ছিল, বাতাস গুমোট, যেন পরিবেশ নিজেই শোক প্রকাশ করছিল।
দুপুরে নিহত দম্পতির বড় ছেলে শোভেন চন্দ্র রায় অজ্ঞাত আসামিকে আসামি করে তারাগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওসি রুহুল আমিন বলেন, ‘সৎকার সম্পন্ন হয়েছে। অজ্ঞাত আসামির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। তদন্ত দ্রুত এগোচ্ছে।
নীরবতার ভেতর থেকে উঠে আসা চিৎকার প্রতিদিনের মতোই রবিবার সকালে দিনমজুর দীপক চন্দ্র রায় যোগেশ চন্দ্রের বাড়িতে কাজ করতে যান। কিন্তু সেই নিয়মের ভিতরেই ঢুকে ছিল অস্বাভাবিক এক নীরবতা। সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত বাড়ির কেউ বের হয়নি। দরজায় ধাক্কাধাক্কি, ডাকাডাকি—সবই ব্যর্থ। পরে প্রতিবেশীদের ডেকে মই বেয়ে প্রধান ফটক টপকে ভেতরে ঢোকেন দীপক।
দৃশ্যটি তিনি আজও থরথর কণ্ঠে বলেন—’ঘরের ভেতর প্রথমে কাউকে পেলাম না। তারপর ডাইনিং রুমের দরজা খুলে দেখি দাদুর দেহ পড়ে আছে। রান্নাঘরে দিদার দেহ। রক্ত…সবকিছু থমকে যাওয়া।’ এটাই ছিল হত্যাকাণ্ডের প্রথম সাক্ষ্য—নীরব, বিধ্বস্ত, আর মর্মান্তিক।
রক্তাক্ত ঘর, জটিল প্রশ্ন খবর পেয়ে তারাগঞ্জ থানা, পরে সিআইডি, পিবিআই, র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের দল ঘটনাস্থলে হাজির হয়। ঘরের ভেতর কোথাও জোরপূর্বক প্রবেশের চিহ্ন নেই—ফলে তদন্তকারীদের কাছে প্রথম প্রশ্নই দাঁড়ায়: পরিচিত কেউ কি এসেছিল সেই রাতে?
পরিবারের তথ্য বলছে—শনিবার রাত ৯টা ২২ মিনিটে ছোট ছেলে রাজেশের সঙ্গে শেষবার কথা হয় যোগেশ চন্দ্র রায়ের। কথা ছিল স্বাভাবিক, কোনো অস্বস্তির ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। এরপরই নেমে আসে রাতের অন্ধকার—আর ঘটে নির্মম হত্যাকাণ্ড। সমাজের ক্ষতচিহ্ন: ‘
এটা বিজয়ের মাস’ স্থানীয়রা ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে শুধু শোক নয়, ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।
কুর্শা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য তুহিনুর রহমান বলেন—’যোগেশ চন্দ্র দাদু খুবই বিনয়ী, পরোপকারী মানুষ ছিলেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এমন নির্মম মৃত্যু—এটা হৃদয়বিদারক।’ তারাগঞ্জের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলী হোসেন বলেন—’বিজয়ের মাসে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এমনভাবে হত্যা করা—এটা জাতির জন্য লজ্জা। দ্রুত অপরাধীদের গ্রেফতার চাই।’
শোকাহত জনতার ভিড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান, মাথায় সাদা চুল আর চোখে রাগ-শোক মেশানো দৃষ্টি—সবই যেন নীরবে এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিল:’কে হত্যা করল আমাদের বীরকে?’ তদন্তের শুরু, শেষের অপেক্ষা কোনো আলামত নষ্ট না হয়—সেদিকে সতর্ক ছিল তদন্তকারী সব সংস্থা। ঘরের প্রতিটি কোণা, আসবাব, দরজার হাতল, দেয়ালের আঁচড়—সবকিছুই এখন পুলিশের কাছে সম্ভাব্য সূত্র। এদিকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
বিএনপি প্রার্থী মোহাম্মদ আলী সরকার, জামায়াতের প্রার্থী এ টি এম আজহারুল ইসলামসহ স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও গণ্যমান্যরা নিহতের বাড়িতে যান। তবে তদন্তকারীদের সামনে এখনো বড় শূন্যতা—কোনো প্রত্যক্ষ শত্রুতা নেই, চুরির চিহ্ন নেই, এমনকি প্রতিবেশীরাও কোনো শব্দ শোনেননি। একটি অদৃশ্য রাত, দুটি প্রাণহীন দেহ—আর প্রশ্নের ঢল। শেষ কথা বিজয়ের মাসের রাতগুলো সাধারণত স্মৃতিতে আলো ফেলে—কিন্তু তারাগঞ্জের এই একটি রাত রেখে গেল অন্ধকার, রক্ত, আর উত্তরহীন প্রশ্ন।
যোগেশ চন্দ্র রায়—একজন মুক্তিযোদ্ধা, যিনি যুদ্ধের আগুন পেরিয়েও বেঁচেছিলেন; কিন্তু নির্মমভাবে হারালেন জীবন তার নিজের ঘরেই। স্মশানের আগুন নিভে গেছে। কিন্তু প্রশ্নের আগুন এখনো জ্বলছে—কে হত্যা করল মুক্তিযোদ্ধা যোগেশ ও তাঁর স্ত্রী সুবর্ণাকে? কেন? তদন্তের পথে সেই উত্তর এখন সবচেয়ে জরুরি।
Sharing is caring!