১লা জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৫ই জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

ভারতের আগ্রাসনের কবলে বাংলাদেশর সংস্কৃতি:

admin
প্রকাশিত মে ৪, ২০২৫, ১২:৪১ পূর্বাহ্ণ
ভারতের আগ্রাসনের কবলে বাংলাদেশর সংস্কৃতি:

জসিম উদ্দীন মাহমুদ তালুকদার

উপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর সাম্রাজ্যবাদীরা যে সকল নতুন কৌশল উদ্ভাবণ করেছে তার মধ্যে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ অন্যতম।বর্তমানে ভারতীয়রা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের শাসন করার নীতি গ্রহণ করেছে। তারা এখন ভূমি দখলের পাশাপাশি আকাশ দখলের ব্যাপারেও বেশী আগ্রহী।
সংস্কৃতি মানুষের একান্তই নিজস্ব এবং প্রতিটি মানুষই তার নিজের সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাঝে নিজের পরিচয় ও অস্তিত্বের সন্ধান পায়।কিন্তু ভারতীয় সংস্কৃতি যা আমাদের দেশে প্রচারিত হচ্ছে তা মানুষিক শান্তি ও আত্মিক প্রশান্তির খোরাক নয় বরং এ সংস্কৃতি এক ধরণের পণ্যে পরিণত হয়েছে।সংস্কৃতির এ পণ্যায়ন আমাদের দেশের সভ্যতার বর্তমান ও আগামী দিনগুলোর জন্য একটি অশনি সংকেত।

ভারতীয়দের এধরণের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে আমাদের সামাজিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ছে। এটি বুঝা যায় বাবার দ্বারা মেয়ে ধর্ষণ কিংবা চাচিকে পেতে স্ত্রীকে তালাকের মত ঘটনা দ্বারা।আবার সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে তরুণরা নানা রকম নৈতিকতা বিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ছে।একটু লক্ষ করলে দেখা যায় ,আগের তুলনায় নারী ঘটিত অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে।

ভারত সরকারের চাপে এদেশের বিগত সরকার, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় অসহায় ছিল। শিল্প, সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশ বিষয়ক অধিকাংশ প্রকল্প সরকার নিয়েছেন ভারতীয়দের চাপে। বাংলাদেশ হয়ে উঠছিল ভারতীয় সংস্কৃতি চর্চার ‘উর্বর ক্ষেত্র’, শিল্পীদের রমরমা বাজার। তারা বাংলাদেশকে ‘বাণিজ্যিক ক্ষেত্র’ হিসেবে বেছে নিয়ে ছিলো। দু’দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তি থাকলেও এসব চলছিল চুক্তির তোয়াক্কা না করে। এ দেশের বিদ্যমান আইন না মেনে তারা চালাচ্ছে তাদের দেশীয় সংস্কৃতির চর্চা। এতে সংস্কৃতি ধ্বংসের পাশাপাশি ভারতে চলে যাচ্ছে দেশের কোটি কোটি টাকা। এ দেশে এখন সরকারি, বেসরকারি অনেক অনুষ্ঠান, মুসলিম সত্ত্বেও মৃত্যুপর শুরু হয় ভারতীয়দের অনুকরণে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে, গাণ-বাদ্য বাজিয়ে পুষ্পকরণে শেষকৃত্য নামক অপসংস্কৃতি।

মন্ত্রী, সচিব, সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব,আওয়ামীপন্থী, ভারতী বাম সমর্থক, বুদ্ধিজীবীরা এটা করছেন বেশির ভাগ। ভারতীয় শিল্পীদের দিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুষ্ঠানের আয়োজন চালিয়েছে। গত ২০২৪ সালের মার্চ মাসে এ দেশের স্বাধীনতা লাভের বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে ছিল ভারতীয়দের জয়জয়কার। অনুষ্ঠান শুরুর আগে ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীত বাজানোও আজকাল আর বিচিত্র কিছু নয়। বিগত সরকারের আমলে ১ এপ্রিল ঢাকায় আয়োজিত রোটারি ক্লাবের বাংলাদেশ শাখার সম্মেলনে নীতিমালা অমান্য করে বাজানো হয় ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীত। শিল্পীর পাশাপাশি হিন্দিভাষী উপস্থাপিকাও আনা হয়েছে। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংগঠনের উদ্যোগে এসব অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে।

এক গবেষণা মতে, সরকারি সহায়তার পাশাপাশি গণমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, সঙ্গীত শিক্ষালয়, নাট্যবিদ্যালয়, নাট্যশালা, আর্ট স্কুল, ফ্যাশন শো, সঙ্গীত-অভিনয়-সুন্দরী প্রতিযোগিতা, পাঠ্যপুস্তক, সাহিত্য, সেমিনার, এনজিও, হাসপাতাল, রূপচর্চা কেন্দ্র, শিক্ষাবৃত্তি, ক্লাব-সমিতি, সাংস্কৃতিক সফর, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি এদেশে ঢুকছে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এক রাষ্ট্রের আইন না মানাটা ওই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননা। অবমাননার বিষয়টা যেভাবে চলে আসছে তাতে সার্বভৌমত্ব বিপন্ন। ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন দিন দিন বিস্তৃত হয়ে উঠছে।’

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ভারত প্রাচীন সংস্কৃতির দেশ হলেও আমরা দেশটির পর্নো সংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকার। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, মিডিয়া ব্যবসায়ীরা ওই পর্নো সংস্কৃতি উপভোগ করছে। এতে এ দেশের সংস্কৃতি বিকশিত হতে পারছে না। সংস্কৃতি চর্চার নামে এ দেশের যারা আইন না মেনে ভারতীয় শিল্পীদের আনছেন, তাদের জবাবদিহি করতে হচ্ছে না। ফলে তারা একের পর এক শিল্পীকে আনছেন।’

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পূর্বে দুই বছর তিন মাসে শতাধিক ভারতীয় সঙ্গীত, অভিনয়শিল্পী এ দেশে কনসার্ট করে। এ সময়ের মধ্যে কতজন এসেছে, এর ঠিক পরিসংখ্যান সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়েও নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে অভিজাত ক্লাবগুলো ভারতীয় শিল্পীকে আনলেও তা গোপন রাখেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লুকোচুরি করে শিল্পীদের আনা হয়। ট্যাক্স ফাঁকি দিতে আয়োজকরা এ লুকোচুরি করেন। অভিজাত ক্লাবগুলো ভারতীয় আইটেম গার্ল, ডিজিটাল জকিদের নিয়ে অনুষ্ঠান করেন অনুমতি ছাড়া। সে দেশের শিল্পীরা এদেশে আসছে। কামিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

আমাদের সংস্কৃতিকে রক্ষার জন্য, সমাজকে কুলষমুক্ত রাখতে হলে ভারতীয় অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধে আমাদের এখই সচেতন হওয়া এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

লেখক পরিচিতি : লেখক ও সংবাদকর্মী।
বাঁশখালী উপজেলা, পৌরসভা, চট্টগ্রাম।

Sharing is caring!