৫ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২০শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৪ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

এক টুকরো মাটি নিয়ে বড় ভাইয়ের প্রতারণা, আর এক জীবনের বিনিময়

admin
প্রকাশিত নভেম্বর ৫, ২০২৫, ০৫:৫৫ অপরাহ্ণ
এক টুকরো মাটি নিয়ে বড় ভাইয়ের প্রতারণা, আর এক জীবনের বিনিময়

Manual6 Ad Code

এক টুকরো মাটি নিয়ে বড় ভাইয়ের প্রতারণা, আর এক জীবনের বিনিময়

লোকমান ফারুক, রংপুর:- রংপুরের তাজহাটের মাটিতে একসময় ছিলো দুই ভাইয়ের পারিবারিক শান্তির সুবাস। পিতা কেরামত প্রামাণিকের রেখে যাওয়া জমিতে দুই ভাই—হবিবর ও নকিবর রহমান—ছিলেন একে অপরের ছায়া। বড় ভাই দেখতেন ছোট ভাইয়ের অংশ, প্রয়োজন হলে ছোট ভাই নিতেন হাত খরচ। সম্পর্কের ভিত ছিলো বিশ্বাসের। কিন্তু সেই বিশ্বাসই একদিন হয়ে দাঁড়াল মৃত্যুর ফাঁদ।

Manual1 Ad Code

ভাই থেকে প্রতারক

পিতা মারা যাওয়ার পর নকিবরের সম্পত্তির দায়িত্ব বড় ভাই হবিবরই সামলাতেন। ছোট ভাই কোনো দিন আপত্তি তোলেননি, এমনকি নিজের নামে খারিজের চেষ্টাও করেননি। সবকিছুই চলছিলো মাটির মতোই স্থির—যতদিন না নকিবরের মৃত্যু হলো। তার মৃত্যুর পর নকিবরের ছেলে শাহ আলম ও দুই বোন হাজেরা ও রোকেয়া পিতার অংশ নিয়ে কখনোই ঝামেলা করেননি। কিন্তু বছর ঘুরে একদিন শাহ আলমের কানে এল গুঞ্জন—তাদের সম্পত্তি অন্যের দখলে গেছে।
লোকমুখের সেই গুঞ্জনই তাকে টেনে নিল রেকর্ড রুমে, পুরোনো দলিলের খাতায়। সেখানেই তিনি খুঁজে পেলেন এক সংখ্যা—৩১০৮১ নম্বর দলিল, তারিখ ১৯/০৯/১৯৬৭। দলিলটি দেখে তার চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠল। দাতা ও গ্রহীতা—দুজনেই একই ব্যক্তি, হবিবর রহমান। অর্থাৎ, বড় ভাই নিজেই দাতা, নিজেই ক্রেতা—আর সেই ‘লেনদেনের’ মাধ্যমে নকিবরের অংশের ৫৯.২৫ শতক জমি নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছেন।
এতেই শেষ নয়—অন্য এক ব্যক্তি, মোসলেম আলীর নামেও জাল দলিল তৈরি করে সেই জমির অবশিষ্ট অংশ বিক্রির নাটক সাজানো হয়।

মৃত্যু ও ন্যায়বিচারের পথ

Manual8 Ad Code

যখন শাহ আলম এ সব জানতে পারেন, তখন হবিবর রহমান মৃত। কিন্তু তার ছয় ছেলে জীবিত—আর তারা সেই জমি একে একে বিক্রি করে চলেছেন। অটোচালক শাহ আলম একদিন ঠিক করলেন, আর চুপ করে থাকবেন না। তিনি পিতার সম্পত্তি উদ্ধারে দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন। এরপরের ঘটনা যেন সিনেমার দৃশ্যের মতোই। এক বিকেলে আরশতপুর মৌজার কামারের মোড়ে কিছু পরিচিত যাত্রী তার অটো ভাড়া নেন, গন্তব্য—মিঠাপুকুর। সেই যাত্রাই ছিলো তার শেষ। পরদিন দুপুরে শহরের মডার্ন মোড়ে লোকমুখে খবর ছড়ায়—মিঠাপুকুর থানার পুলিশ এক অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করেছে। লাশটি শাহ আলমের। স্ত্রী আফরোজা বেগমের কথায়, “সেদিন রাতে সে ফেরেনি। সকালে শুনলাম—আমার স্বামীকে মেরে ফেলে রেখে গেছে তারা।’ পুলিশ লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠিয়েছে। আমি নিজে গিয়ে লাশ শনাক্ত করি।’

অভিযোগ, তদন্ত, আর নীরবতা

আফরোজা বলেন, ‘আমি থানায় গিয়ে যাদের সন্দেহ করি তাদের নাম বলেছিলাম। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা আমার কোনো কথা শোনেননি। বরং দিনের পর দিন আমাকে ডেকে বিব্রত করতেন।’

রংপুরের আদালতে দায়রা নং ১০৩০/১৫ (জি আর নং ৪৩৩/১৩, মিঠাপুকুর) হিসেবে মামলাটি এখনও বিচারাধীন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ফারজানা আক্তার কণা জানান, “একজন আসামির মৃত্যুর খবর এসেছে, তার সত্যতা যাচাইয়ে থানা থেকে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে।’ প্রতিবেদন এলে বিচারকাজ শুরু হবে।’

মিঠাপুকুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ: নূরে আলম সিদ্দিকীর কাছে “ভিকটিমের স্ত্রীর অভিযোগ” বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি শুধু বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’

Manual1 Ad Code

জমি—যা একসময় ছিল জীবনের প্রতীক

আজও তাজহাটের সেই জমির দাগ নম্বর, খতিয়ান আর জে এল নম্বরগুলো হাজেরা বেগমের মুখস্থ।
তিনি বলেন, “জেলা রংপুর, থানা কোতোয়ালি, মৌজা তাজহাট, জে এল নং ৯৭, হাল খতিয়ান ৮৫০, দাগ নং ৫২২০—১.৪০ একর। দাগ নং ৫২১৯—০.৯৭ একর। সর্বমোট জমি ২.৩৭ একর মধ্যে,০.৪৭৪০।’ এই জমিই ছিল আমাদের জীবন। ভাই সেই জমির জন্য প্রাণ দিল। আমরা বোনেরা এখনো ঘুরে বেড়াই সেই ন্যায়ের আশায়।’
তার চোখে ক্লান্তির ছায়া, কণ্ঠে তীব্র অভিমান—’এই জমি উদ্ধারে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু জ্যাঠা হবিবর আর তার ছেলেদের টাকা-পয়সা ও প্রভাবের কাছে কোথাও টিকতে পারিনি।’
হবিবর রহমানের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে কেউই মুখ খুলতে রাজি হননি।

ন্যায় পাওয়ার আশা

এক ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় আরেক ভাইয়ের পরিবারে প্রজন্মজুড়ে বয়ে চলা শোক, আর ন্যায়বিচারের অপেক্ষা। তাদের কণ্ঠে একটাই আবেদন—”মিথ্যা দলিল ও তথ্য গোপনের মাধ্যমে আমাদের পৈত্রিক জমি আত্মসাৎ কারীদের বিচার চাই।’ রাষ্ট্র যেন ন্যায্য মালিকানা ফিরিয়ে দেয়, আর আমাদের ভাইয়ের হত্যার সুবিচার নিশ্চিত করে।’
অন্যায়ের এই দীর্ঘ ছায়া সরিয়ে ন্যায়বিচারের আলো দেখার আশায়, তারা আজও তাকিয়ে আছেন সরকারের দিকে।
৫ নভেম্বর ২০২৫

Manual7 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code