১৯শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৮শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

রংপুরে বাড়ছে দুর্ঘটনা, ১১ মাসে সড়কে ঝরেছে ২১৩ প্রাণ

admin
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১৯, ২০২৫, ১০:০৫ অপরাহ্ণ
রংপুরে বাড়ছে দুর্ঘটনা, ১১ মাসে সড়কে ঝরেছে ২১৩ প্রাণ

Manual1 Ad Code

লোকমান ফারুক, রংপুর

Manual8 Ad Code

ভোরের আলো ফোটার আগেই রংপুরের মহাসড়কগুলো জেগে ওঠে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে ছুটে চলে বাস-ট্রাক, পণ্যবাহী লরি আর মোটরসাইকেল। কেউ যাচ্ছে জীবিকার খোঁজে, কেউ ফিরছে ঘরে। কিন্তু এই চলমান স্রোতের ভেতরেই নীরবে লুকিয়ে থাকে এক অদৃশ্য আতঙ্ক—এই পথই হয়তো বা কারও শেষ গন্তব্য।

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর—এই ১১ মাসে রংপুর অঞ্চলে সড়ক দুর্ঘটনা আর পরিসংখ্যানের সংখ্যা নয়, এক একটি থেমে যাওয়া জীবন। এই সময়ে অন্তত ৪১০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২১৩ জন নিহত এবং ৪৬৪ জন আহত হয়েছেন।

Manual7 Ad Code

নিহতদের কেউ বাবা, কেউ সন্তান, কেউবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ। আর যারা বেঁচে ফিরেছেন, তাঁদের অনেকেই ফিরেছেন পঙ্গুত্বের বোঝা নিয়ে—মানবেতর জীবনের দিকে ঠেলে দেওয়া এক দীর্ঘ অনিশ্চয়তায়।

Manual1 Ad Code

সংখ্যার আড়ালে মানুষের গল্প

দুই মাস আগে নাট্যকার ও ভাওয়াইয়া গবেষক আশরাফুজ্জামান বাবু বদরগঞ্জ থেকে রংপুর শহরের দিকে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক মুহূর্তের দুর্ঘটনা। মুখে ও ঠোঁটে একের পর এক সেলাই—শরীরের ক্ষত শুকালেও ভেতরের ধাক্কা এখনও তাজা।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে রাশেদ এখন হুইলচেয়ারে বন্দি। যে মানুষটি একসময় পরিবারের হাল ধরেছিল, আজ সে নিজেই বোঝা হয়ে গেছে নিজের কাছে।
রংপুর নগরীর নজিরেরহাট এলাকার আব্দুর রহিম অনিক—২৪ সেপ্টেম্বর বদরগঞ্জ রোডে স্ত্রী ও সন্তানসহ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলেও সুস্থতা এখনও অধরা। ধারদেনার বোঝা আর চিকিৎসার খরচ—এই দুশ্চিন্তায় প্রতিদিন কাটছে অনিকের পরিবার। বাবু, রাশেদ, অনিক—এরা শুধু কয়েকটি নাম। আড়ালে রয়ে গেছে আরও অসংখ্য গল্প, যাদের খবর কখনো শিরোনাম হয় না।

সড়কে চাপ আর বেপরোয়া গতি

হাইওয়ে পুলিশ রংপুর রিজিয়ন সূত্র জানায়, তেঁতুলিয়া, বোদা, সাতমাইল, তারাগঞ্জ, বড়দরগা, গোবিন্দগঞ্জ ও হাতীবান্ধা—এই সাতটি থানার আওতায় ৩৭৩ কিলোমিটার মহাসড়ক ও ১৩৮ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়ক রয়েছে। প্রতিদিন এই সড়ক দিয়েই উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানীসহ দেশের নানা প্রান্তে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন চলে। যানবাহনের চাপ, সড়কের কিছু অংশের নাজুক অবস্থা, অতিরিক্ত গতি আর বেপরোয়া ওভারটেকিং—সব মিলিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি যেন প্রতিদিন একটু একটু করে বেড়েই চলেছে।

এই ১১ মাসে দুর্ঘটনাজনিত ঘটনায় ১৯০টি মামলা হয়েছে। পাশাপাশি সড়ক আইন অমান্যের দায়ে ১৪ হাজার ৭৫৮টি মামলা দিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। আইন আছে, মামলা আছে, রাজস্বও উঠছে—কিন্তু কমছে না মৃত্যু।

Manual5 Ad Code

আইনের প্রয়োগ বনাম বাস্তবতা

হাইওয়ে পুলিশ নিয়মিত টহল, যানবাহন তল্লাশি, লিফলেট বিতরণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও চালকদের প্রশিক্ষণ, সড়ক আইন বিষয়ে প্রচার—সবই চলছে কাগজে-কলমে।
কিন্তু যাত্রী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন একটাই—তাহলে থামছে না কেন এই মৃত্যু মিছিল? তাঁদের মতে, দক্ষ চালকের অভাব, বিশ্রামহীন দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানো, ফিটনেসবিহীন যানবাহন আর লাইসেন্সহীন চালকের দাপট—সব মিলিয়ে সড়ক যেন এক নিয়ন্ত্রণহীন যুদ্ধক্ষেত্র।

কর্তৃপক্ষের ভাষ্য

হাইওয়ে পুলিশ রংপুর রিজিয়নের পুলিশ সুপার আবু তোরাব মো. শামছুর রহমান বলেন, “অতিরিক্ত গতি, বেপরোয়া ওভারটেকিং, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও অদক্ষ চালকই অধিকাংশ দুর্ঘটনার মূল কারণ। আমরা নিয়মিত টহল ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছি। ভবিষ্যতে নজরদারি আরও জোরদার করা হবে।”

জাতীয় চিত্র, স্থানীয় প্রতিচ্ছবি

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, শুধু নভেম্বর মাসেই সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৮৩ জন নিহত ও ১ হাজার ৩১৭ জন আহত হয়েছেন। অক্টোবরে যেখানে দৈনিক গড় মৃত্যু ছিল ১৪ দশমিক ২২ জন, নভেম্বরেই তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ১ জনে—প্রাণহানি বেড়েছে ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ। এই সংখ্যাগুলো রংপুরের সড়কে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোরই প্রতিচ্ছবি।

শেষ প্রশ্ন

প্রতিদিন যে সড়ক দিয়ে মানুষ স্বপ্ন নিয়ে বের হয়, সেই সড়কই কেন এত মানুষের স্বপ্ন কেড়ে নেয়? আইন আছে, তবু ভয় নেই। শাস্তি আছে, তবু বেপরোয়া গতি থামে না।

ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রংপুরের মহাসড়ক আবার জেগে উঠবে। গাড়ি ছুটবে, মানুষ চলবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাবে—এই যাত্রা কি সবাইকে ঘরে ফেরার নিশ্চয়তা দিতে পারবে? নাকি পরিসংখ্যানের তালিকায় আরও কিছু নাম যোগ হবে?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার দায় শুধু পুলিশের নয়, শুধু প্রশাসনের নয়—এ দায় আমাদের সবার। না হলে এই পথই বারবার হয়ে উঠবে অনেকের শেষ ঠিকানা।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code