১৩ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২২শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

ভালো বিতর্কই সুস্থ গণতন্ত্রের ভিত্তি—প্রেসসচিব শফিকুল আলম

admin
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৭, ২০২৫, ০৩:১৯ অপরাহ্ণ
ভালো বিতর্কই সুস্থ গণতন্ত্রের ভিত্তি—প্রেসসচিব শফিকুল আলম

Manual7 Ad Code

বিশেষ প্রতিনিধি

রোববার সকালটায় রাজধানীর ডিজিটাল পরিসর যেন একটু থমকে দাঁড়ায়।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে একটি দীর্ঘ পোস্ট দেন—শব্দগুলো শান্ত, কিন্তু ভিতরে প্রবাহিত হয় এক ধরনের নৈতিক অস্থিরতা, গণতন্ত্রের ভেতরের অসমাপ্ত প্রশ্নগুলোকে সামনে এনে দাঁড় করানো ভাষা।

Manual4 Ad Code

তিনি লেখেন—’ভালো বিতর্কই একটি সুস্থ গণতন্ত্রের ভিত্তি। ব্যক্তিগত আক্রমণ ও অবজ্ঞামূলক ভাষা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে।’ কথাগুলো যেন শুধু কারও উদ্দেশে নয়; বরং রাজনীতির আড়ালে জমে থাকা অবিশ্বাসের দিকে এক সতর্ক আলোকপাত।

শফিকুল আলম তাঁর পোস্টে ফিরে গেছেন ২০০৬ সালের ফুলবাড়ীর রক্তাক্ত অধ্যায়ে—’হত্যাকাণ্ডের খবর প্রথম বিদেশি সংবাদদাতা হিসেবে সম্ভবত আমিই প্রকাশ করেছিলাম… আন্দোলনকারীরা নিহত হয়েছে—এ কথা পুলিশকে স্বীকার করাতে কী চাপ সামলাতে হয়েছিল, আজও মনে আছে।’

Manual2 Ad Code

তখন তিনি এএফপির ঢাকা সংবাদদাতা। তাঁর প্রতিবেদন যুক্তরাজ্যে আলোড়ন তুলেছিল, কারণ প্রকল্পের অনুমতিপ্রাপ্ত কোম্পানি এশিয়ান এনার্জি লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ছিল। তিনি লিখেছেন ‘তখন অবশ্যই আমি নিন্দা করেছিলাম, আজও করছি।’

এই স্মৃতিচারণই যেন তাঁর বর্তমান ব্যক্তিগত মতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা এক নৈতিক আয়না—যা তিনি নিজেই পোস্টে তুলে ধরেছেন: ‘যদি এখনো এএফপিতে কাজ করতাম, তাহলে সম্ভবত এখন যে অবস্থান নিয়েছি, সেটারই তীব্র সমালোচনা করতাম।’

পোস্টটি আরও গভীরে টেনে নেয় দেশের সাম্প্রতিক সহিংসতার পরম্পরাকে—’বহু বছর ধরে পুলিশ ও সীমান্তরক্ষীরা আন্দোলন দমনে ট্রিগার-হ্যাপি হয়ে উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এই সহিংসতার চক্র ভাঙতে কঠোর পরিশ্রম করছে।’ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও নাগরিক অধিকারের সূক্ষ্ম সীমানায় এই স্বীকারোক্তি নতুন আলোচনা তৈরি করেছে—একজন সরকারি পদধারী মুখপাত্রের কাছ থেকে এমন সরাসরি বক্তব্য বিরল।

তারপর তিনি প্রবেশ করেছেন বর্তমান জ্বালানি বাস্তবতায়—’বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক ওঠানামা, ইউক্রেন যুদ্ধের পর কয়েক গুণ বেশি দামে এলএনজি কেনার চাপ’—এসব উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘এ দামে এলএনজি কিনে টিকে থাকা সম্ভব নয়। রিজার্ভ খরচ করা বা কারখানা বন্ধ রাখা—দুই পথই ছিল ভয়ঙ্কর

 

Manual1 Ad Code

‘ এই প্রেক্ষাপটেই তিনি তোলেন গুপ্ত প্রশ্ন—বাংলাদেশ কি বড় ভুল করেছে নিজের কয়লা মজুত কাজে না লাগিয়ে? ‘ফুলবাড়ী, দিঘীপাড়া ও জামালগঞ্জের কয়লা না তোলা একটি বড় ভুল। যদি চুক্তি ত্রুটিপূর্ণ হয়, সংশোধন করে নতুন অংশীদার খোঁজা যেত—বিহেপি, রিও টিন্টোদের মতো।’

Manual6 Ad Code

এই বক্তব্যই তাঁর পোস্টকে ঘিরে বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে। তাঁর লেখার প্রতিক্রিয়ায় যে সমালোচনা এসেছে—তিনি তা গ্রহণও করেছেন। মাহতাব উদ্দিন আহমেদসহ বিভিন্ন গবেষকের বিশ্লেষণকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন, কিন্তু তাঁর অবস্থান বদলাননি।

পোস্টে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্পষ্টীকরণও যুক্ত করেছেন— ‘আমার মতামত ব্যক্তিগত; এটি সরকারের কোনো নীতির প্রতিফলন নয়। সরকারের ফুলবাড়ী প্রকল্প পুনরুজ্জীবনের পরিকল্পনা নেই—আমার জানামতে।’

শফিকুল আলম দীর্ঘদিন বামপন্থীদের মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে তাঁদের অবস্থানের প্রশংসা করে এসেছেন। কিন্তু তাঁর মন্তব্যে উঠে এসেছে কঠোর সমালোচনাও—’অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক প্রশ্নে বামপন্থীরা ভুল পথে ছিলেন।

চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে আন্দোলন অনেক সময় লাডাইট মানসিকতার মতো।’ তিনি মনে করেন—শ্রমিকদের বড় অর্জনগুলো এসেছে আন্তর্জাতিক ক্রেতা ও অধিকার সংগঠনগুলোর চাপ থেকে, স্থানীয় বাম আন্দোলন থেকে নয়।

পোস্টটি শেষ হয়েছে এক ধরনের নৈতিক অস্বস্তি রেখে। যেন তিনি নিজকেই জিজ্ঞেস করছেন—একজন সাংবাদিক যখন রাষ্ট্রের ভেতরে প্রবেশ করেন, তখন কি তাঁর অবস্থান বদলে যায়, নাকি বাস্তবতা তাঁকে বদলে দেয়?

এই প্রশ্নই পোস্টের শুরু ও শেষকে একটি গোপন সুতায় বেঁধে দেয়—গণতন্ত্র কি সত্যিই ভালো বিতর্কের ওপর দাঁড়ায়, নাকি বাস্তবতার কঠিন ভূখণ্ডে তা প্রায়ই ঝাপসা হয়ে যায়?

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code