ডেস্ক রিপোর্ট, রংপুর
রংপুর শহরের দুপুরটা আজ অস্বাভাবিকভাবে ভারী- শীতের কুয়াশা নয়, চাপা ক্ষোভের কুণ্ডলী যেন বাতাসে ঝুলছে। একটি কমিউনিটি সেন্টারের বন্ধ ঘরে জমে ওঠা উত্তেজনা পেরিয়ে বেরিয়ে এল একটাই ঘোষণা—প্রিপেইড মিটার স্থাপন বন্ধে নির্বাহী আদেশ না এলে হরতাল-অবরোধ হবে।
ঘোষণাটি দিয়েছেন রংপুর মহানগর নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট পলাশ কান্তি নাগ। সংবাদ সম্মেলনে পলাশ কান্তি নাগ যখন লিখিত বক্তব্য পড়ছিলেন, তখন কক্ষে এক ধরনের অদৃশ্য গুঞ্জন তৈরি হচ্ছিল—জবরদস্তি, হয়রানি, বাড়তি খরচ আর অনিশ্চয়তার গল্পের গুঞ্জন। যেন বিদ্যুতের তারে জমে থাকা অসংখ্য অভিযোগ আজ একসাথে শব্দ খুঁজে পেল।
তিনি অভিযোগ করেন, নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) গ্রাহকদের আপত্তি সত্ত্বেও নানা কৌশলে, কখনো চাপ দিয়ে, কখনো হুমকির আভাসে প্রিপেইড মিটার বসানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
ইতিপূর্বে গ্রাহকদের আন্দোলনের পর তৎকালীন জেলা প্রশাসক নেসকোকে মিটার স্থাপন স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু নেসকো যেন সেই নির্দেশনাকে বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছে—এমনই অভিযোগ তার।
তিনি বলেন, “এত বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে নেসকোর গণশুনানি করা উচিত ছিল। গ্রাহকদের মতামত শোনাই হয়নি। উন্নয়ন মানুষের ওপর চাপিয়ে দিলে তা উন্নয়ন থাকে না—হয়রানি হয়।” সংবাদ সম্মেলনে এক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে আসে—প্রিপেইড মিটার কি বিদ্যুৎ আইনের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক?
পলাশ কান্তি নাগ বলেন, বিদ্যুৎ আইন ২০০৩-এর ৫৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করার আগে ১৫ দিন নোটিশ দিতে হয়। কিন্তু প্রিপেইড মিটারে টাকা শেষ হলেই সঙ্গে সঙ্গে সংযোগ বন্ধ।
‘এটা কি আইনসঙ্গত?’—প্রশ্নটি কক্ষে উপস্থিত সবার মনে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি আরও জানান—”প্রতিবার ১ হাজার টাকা রিচার্জে ২০ টাকা এজেন্ট কমিশন। মাসে ৪০ টাকা মিটার ভাড়া—কতদিন দিতে হবে জানা নেই। রিচার্জ না থাকলে ২০০ টাকা ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স, সুদ ৫০ টাকা ‘এবং কোন রেটে কত ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে—এটাও স্পষ্ট নয়।
গ্রাহকদের অনেকেই বছরের পর বছর নিজের টাকায় অ্যানালগ ও ডিজিটাল মিটার কিনেছেন। সে বিনিময়ে কোনো রিফান্ড নেই। এইসব অঙ্ক মিলিয়ে দাঁড়ায় এক কঠিন বাস্তবতা—বিদ্যুৎ ব্যবহারের আগে গ্রাহকরা যেন এক অদৃশ্য আর্থিক জালে আটকে যাচ্ছেন।
পলাশ কান্তি স্মরণ করিয়ে দেন, “বিগত সরকার বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়িয়েছে। রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে, অথচ উৎপাদন হয়নি। বেসরকারি কোম্পানিগুলো বিদ্যুৎ না দিয়েই গত ১০ বছরে ৫১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা পেয়েছে—এই পরিসংখ্যান উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে কক্ষের ভিতর যেন আরও অল্প আলো অন্ধকার হয়ে ওঠে।
সংবাদ সম্মেলনের শেষাংশে তিনি বলেন—’৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে জেলা প্রশাসক নির্বাহী আদেশ না দিলে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ থাকবে না। ঘোষণার পর ঘর থেকে বেরিয়ে আসা মানুষদের চোখে ছিল এক ধরনের মিশ্র অনুভূতি—সম্ভাব্য অচলাবস্থার ভয়, আবার অন্যদিকে নিজের অধিকার রক্ষার দৃঢ়তা।
একটি প্রশ্ন: বিদ্যুৎ কি সেবা, নাকি পণ্য? গ্রাহক কি নাগরিক, নাকি কেবল একজন হিসাবের খাতা? এ সংকট কি প্রযুক্তির প্রয়োগ, নাকি জনগণকে উপেক্ষা করে নেওয়া তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তের ফল।
দুপুরের ভারী বাতাসে যে উত্তেজনা জমেছিল, সংবাদ সম্মেলন শেষে তা আরও ঘনীভূত হয়ে বেরিয়ে এল—রংপুরের রাস্তায়, বাসাবাড়িতে, দোকানে, মানুষের কথাবার্তায়। প্রিপেইড মিটার—নামটা সরল হলেও এর ভবিষ্যৎ প্রভাব যেন সরল নয়।
Sharing is caring!