১৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৭শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

শহীদ শাফী ইমাম রুমী।

admin
প্রকাশিত আগস্ট ৩০, ২০২৫, ০৮:৪৭ অপরাহ্ণ
শহীদ শাফী ইমাম রুমী।

Manual2 Ad Code

বিশেষ প্রতিনিধি।

নিঃশঙ্ক এক যোদ্ধার নাম আজ সেই ২৯ আগস্ট অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শাফী ইসলাম রুমী পাকি হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধৃত হন এই দিনে। বাংলার গেরিলা যুদ্ধের পথিকৃৎ ক্র্যাক প্লাটুন’ স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উজ্জ্বলতম এক নক্ষত্রের নাম। এই গেরিলা দলেরই অন্যতম সদস্য ছিলেন সদ্য আইএসসি পাস করা রুমী। তখন বয়স তাঁর মাত্র বিশ।

Manual4 Ad Code

১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ প্রকৌশলী শরীফ ইমাম ও জাহানারা ইমামের ঘর আলো করে এলো এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান। কবি জালালুদ্দীন রুমীর মতো জ্ঞানী ও দার্শনিক হবে ভেবে মা জাহানারা ইমাম ছেলের নাম রাখলেন রুমী। এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

এরই মধ্যে আমেরিকার ইলিনয় স্টেটের শিকাগো শহরে ইলিনয় ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ডাক আসে। ভর্তিও হন। ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে। এদিকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। চালায় হত্যাযজ্ঞ। মুক্তিকামীদের মুক্তির জন্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে! দেশকে যুদ্ধের মধ্যে রেখে বিদেশে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবেন? বিবেক সায় দেয়নি তাঁর।

Manual3 Ad Code

তাই সেখানে পড়ার সুযোগকে তোয়াক্কা না করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দেশমাতৃকার ডাকে যুদ্ধে, শত্রু হননে! মা-বাবা রাজি ছিলেন না। শেষমেশ ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মাকে রাজি করিয়েই ২ মে সীমান্ত অতিক্রমের প্রথম প্রয়াস চালান রুমী। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তাঁকে ফিরে আসতে হয়। এরপর চালান দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। সফল হন। যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নেন সেক্টর-২ এর অধীনে মেলাঘরে।

Manual8 Ad Code

এই সেক্টরটির পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন খালেদ মোশাররফ ও রশিদ হায়দার। প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকায় ফেরেন। যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী সংগঠন ক্র্যাক প্লাটুনে। উদ্দেশ্য সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে হামলা করা। সে সময় তাঁকে বেশ কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনা করতে হয়।

ধানমণ্ডি রোডের একটি আক্রমণ ছিল এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সেখানে একটি পাকিস্তানি সেনা জিপ তাঁদের বহনকারী গাড়ির পিছু নিলে স্টেন গান ব্রাশফায়ার করেন। তাঁর গুলিতে নিহত হয় পাকিস্তানি জিপের ড্রাইভার, গাড়ি ধাক্কা খায় ল্যাম্পপোস্টে। এরপর বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা তাঁর গুলিতে মারা যায়।

১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন আগের দিন। গভীর রাতে বাবা, ভাই, বন্ধু, চাচাতো ভাইসহ রুমীকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ধরা পড়ে ক্রাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলম, মাসুদ সাদেক চুল্লু, আলতাফ মাহমুদ এবং তাঁর চার শ্যালক, আবুল বারক আলভী, আজাদ জুয়েল, বাশারসহ অনেকে।

এমপি হোস্টেলের টর্চার সেলে নেওয়ার পর রুমী তাঁর বাবা, ভাইকে বলেছিলেন, ‘তোমরা কেউ কিছু স্বীকার করবে না। তোমরা কেউ কিছু জানো না। আমি তোমাদের কিছু বলিনি’। ভয়ংকর অত্যাচারেও একটি তথ্যও রুমীর কাছ থেকে বের করা যায়নি। ৩০ আগস্টের পর রুমী ও তাঁর সহযোদ্ধা বদীকে এরপর আর কখনও দেখা যায়নি।

২৯ মার্চ, ১৯৭১ এ রুমির জন্মদিনে জাহানারা ইমাম ও শরীফ ইমাম আশীর্বাদ লিখেছিলেন, ‘বজ্রের মতো হও, দীপ্ত শক্তিতে জেগে ওঠো, দেশের অপমান দূর কর, দেশবাসীকে তার যোগ্য সম্মানের আসনে বসাবার দুরূহ ব্রতে জীবন উৎসর্গ করো’। শহীদ শাফী ইমাম রুমী কথা রেখেছেন, তা-ই করে গেছেন।

পাকিস্তানি জান্তারা রুমীর বাবা, ভাই, বন্ধু, চাচাতো ভাইকে ছেড়ে দিলেও রুমীকে ছাড়ে না। পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে রুমীদের গেরিলা অপারেশনের সব খবরই ছিল। রুমী শুধু ২৫ আগস্ট রাতের অপারেশনের কথা স্বীকার করেন। ভয়ংকর অত্যাচার চলে তাঁর ওপর। কিন্তু ওরা তাঁর কাছ থেকে আর কারও নাম জানতে পারেনি। ছেলের মাথা সমুন্নত রাখতে রুমীর প্রাণ ভিক্ষার জন্য সরকারের কাছে আবেদনও করেননি মা-বাবা। ৫ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। কিন্তু সেটা পাকিস্তানি সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেরই পছন্দ ছিল না।

Manual2 Ad Code

তাই এর আগের রাতে অর্থাৎ ৪ সেপ্টেম্বর তাড়াহুড়ো করে শ খানেক বন্দীকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। ধারণা করা হয়, রুমী সেই ৪ সেপ্টেম্বর শহীদ হন। আজ আবার সেই ২৯ আগস্ট ফিরে এসেছে। আজ সেই অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা শাফী ইমাম রুমীর ধৃত হবার দিন। বছর ঘুরে এভাবেই ২৯ আগস্ট ফিরে ফিরে আসবে, কিন্তু রুমী ফিরবেন না। তাঁর বয়সও আর বাড়বে না।

স্বাধীনতার শতসহস্র বছর পরেও থেকে যাবেন তিনি কুড়ি বছরের তরুণ হয়ে! শ্রদ্ধাঞ্জলি।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code