লোকমান ফারুক, রংপুর
রংপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষের জানালার কাঁচে দুপুরের আলো তখনো ভারী। আলো ভেদ করছিল কুয়াশার মতো থমথমে এক পরিবেশ, যেখানে সংখ্যার উল্টো পিঠে দাঁড়িয়ে ছিল ভয়, ক্ষত আর অস্থিরতার বর্ণহীন ছায়া। আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক সভা শুরু হতেই মনে হলো—এই শহর যেন নিজের বুকের ভেতর লুকানো সত্য হঠাৎ করে ছিটকে বাইরে ফেলতে চাইছে।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খৃস্টফার হিমেল রিছিল তথ্য তুলে ধরলেন এমন ভঙ্গিতে, যেন একটি অধ্যায়ে রংপুরের সাম্প্রতিক ইতিহাস লিখে রাখছেন—কাগজের ওপর নয়, মানুষের নিরাপত্তাবোধের দেয়ালে। তিনি বললেন, ‘গত তিন মাসে (সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর) রংপুরে ঘটেছে ১৩টি খুন, ৩৭টি ধর্ষণ, আর মোট ৮৯৯টি অপরাধ।’ সংখ্যাকে যদি একটি মানচিত্র ধরা হয়, তবে রংপুরের গত শরৎকাল ছিল রক্তাক্ত আর অশ্রুভেজা এক ঋতু।
সেপ্টেম্বর: ক্ষতচিহ্নের প্রথম ছাপ
তথ্যের স্তুপে একটু থেমে রিছিল বললেন—’সেপ্টেম্বরে ৬ জন খুন, ৩৫টি চুরি, ৪টি অপহরণ, ৯টি ধর্ষণ, এবং ২৮টি নারী নির্যাতন।’
মোট অপরাধ— ৩০৪টি।
সেপ্টেম্বর যেন শহরের দরজায় টোকা দিয়েছিল সতর্ক সংকেত দিয়ে—কিন্তু কেউ শুনেছিল কি? না কি শহর কেবল নিজের ব্যস্ততার ভিড়ে ভুলে গিয়েছিল প্রতিটি ঘটনার গভীরতাকে?
অক্টোবর: অন্ধকারের বিস্তার
অক্টোবরে খুনের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫, চুরি ৩২টি, সিধেল চুরি ৩টি, অপহরণ ৩টি। নারী ও শিশু নির্যাতন— ৪১টি।
এ মাসে ধর্ষণ হয়েছে ২১টি, যার ২০টিই ঘটেছে উপজেলা পর্যায়ে। একটি ডাকাতির ঘটনাও নথিভুক্ত হয়।
মোট অপরাধ— ৩১৩টি।
এই মাসটি যেন তারিখ পেরোলেই নতুন দাগ রেখে যাচ্ছিল। সভাকক্ষে কিছু মুখ শক্ত হয়ে উঠল—শহরের কেন্দ্র নয়, বরং আশপাশের উপজেলাগুলোই যেন রংপুরের সবচেয়ে নাজুক চৌহদ্দি।
নভেম্বর: নিঃশব্দ আতঙ্ক
নভেম্বরে খুন হয়েছে ২ জন। চুরি ২০টি, সিধেল চুরি ২টি, অপহরণ ৩টি। নারী ও শিশু নির্যাতন ৩৫টি, যার মধ্যে ৩৩টি ঘটেছে নগরের বাইরে। এই মাসে ধর্ষণের শিকার ৭জন। মোট অপরাধ— ২৮২টি।
একটি শহর যখন কেন্দ্রের ভেতর শান্ত দেখায় কিন্তু প্রান্তে তার শিরা-ধমনি কেটে যাচ্ছে—তখন বোঝা যায় বিপদ কতটা গভীর।
সভাকক্ষের নীরবতা ও নৈতিক প্রশ্ন
সভাপতিত্ব করছিলেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল আহসান। পাশে পুলিশ সুপার মো. মারুফাত হুসাইন, সিভিল সার্জন ডা. শাহীন সুলতানা, সরকারি আইনজীবী আব্দুল হাদী বেলালসহ নানাজন।
তাদের দৃষ্টি, বক্তব্য, ভাবভঙ্গি—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল শহর যেন আজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে।
কিন্তু সেই আয়নায় একটি প্রশ্ন ভেসে উঠছিল—রংপুরের মানুষ কি আর নিরাপত্তাকে স্বাভাবিক অধিকার হিসেবে দেখতে পারবে? নাকি প্রতিটি সন্ধ্যা এখন হয়ে উঠবে ভয়ের একটি নতুন শিরোনাম?
অপরাধের পরিসংখ্যান কখনোই কেবল সংখ্যা নয়। তারা বয়ে আনে শোক, অপমান, প্রতিশোধহীনতা আর ন্যায়বিচারের অপূর্ণ প্রতিজ্ঞার গল্প। ঠিক যেমন কোনো গোপন নোটবইয়ে আমাদের প্রথিতযশা সাংবাদিকরা হয়তো লিখে রাখতেন—ঘটনার আড়ালে যে সত্য আছে, সেটিই তদন্তের আসল লক্ষ্য।
সভা শেষের আগে দরজার বাইরে বিকেলের আলো ফিকে হয়ে এল। যেন শহর নিজেই একটু নিঃশ্বাস ফেলল, আবার শঙ্কায় কেঁপে উঠল। এই তিন মাসের পরিসংখ্যান রংপুরকে শুধু একটি হিসাব দেয়নি—এটি দিয়েছে এমন এক বার্তা, যা উপেক্ষা করলে সামনের সময় আরও অন্ধকার হতে পারে।
রংপুরের প্রশ্ন এখন একটাই—
যে শহর তার নাগরিকের নিরাপত্তা হারায়, সে কি কেবলই একটি শহর থাকে, নাকি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে অস্থিরতার মানচিত্র? সংখ্যার ভেতরে লুকানো এই নৈঃশব্দ্যই রংপুরের আজকের বাস্তবতা। আর সেই নৈঃশব্দ্যই আবার গল্পের মতো ফিরে আসে—শুরুর থমথমে আলোয়, যেখানে সত্য কখনোই চাপা পড়ে থাকে না।
Sharing is caring!