১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১লা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৫শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

দামুর চাকলা উচ্চ বিদ্যালয়ে সার্টিফিকেট জিম্মি: ২২ হাজার টাকার দাবিতে অভিভাবকের দৌড়ঝাঁপ

admin
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৩, ২০২৫, ০৯:২৭ অপরাহ্ণ
দামুর চাকলা উচ্চ বিদ্যালয়ে সার্টিফিকেট জিম্মি: ২২ হাজার টাকার দাবিতে অভিভাবকের দৌড়ঝাঁপ

Manual5 Ad Code

বিশেষ প্রতিনিধি, রংপুর

সকালবেলার ম্লান রোদ পীরগাছা উপজেলার দামুর চাকলা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিল্ডিং ঘরে লেগে আছে। মাঠে কয়েকজন অভিভাবক দাঁড়িয়ে ফিসফাস করছেন—যেন কেউ একজন অদৃশ্য জালে আটকে রেখেছে তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ। বিদ্যালয়ের ভেতরের বাতাসে অস্বস্তির গন্ধ—শিক্ষার নামে অন্যায় লেনদেনের ছাপ। ঠিক এর মধ্যেই অভিযোগ তুলে ধরলেন ভ্যানচালক মোহারম আলী। তার কণ্ঠে অসহায়তা, আবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা—’আর কিছুই নাই, কিন্তু ছেলের পড়ালেখার কাগজ কেউ আটকে রাখতে দিব না।’

ঘটনাটি শুরু হয় তার ছেলের প্রশংসাপত্র ও নম্বরপত্রকে ঘিরে। ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ পাওয়া ছেলে, রংপুর সরকারি কলেজে ভর্তির জন্য ছুটে গেলে; বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক খন্দকার ফখরুল ইসলাম তাকে পাঠিয়ে দেন লাইব্রেরিয়ান এমদাদুল হক মিলনের কাছে। যেন এই স্কুলে নথিপত্রের চাবি এখন আর প্রধান শিক্ষকের হাতে নেই—অন্য কারও অদৃশ্য কর্তৃত্ব সেখানে কাজ করছে।

২২ হাজার না দিলে কাগজ পাবেন না’—অভিভাবকের অভিযোগ

Manual3 Ad Code

মোহারম আলী তার অভিযোগে লিখেছেন—মিলন সরাসরি ২২ হাজার টাকা দাবি করেন। অসহায় অভিভাবক সুদের টাকা ধার করে প্রথমে ১০ হাজার দেন। তবেই তিনি প্রশংসাপত্র পান।
নম্বরপত্র চাইতে গেলে মিলনের সোজাসাপ্টা জবাব—
‘টাকা দেন, না হলে নম্বরপত্র পাবেন না।’
প্রতিবেদকের পর্যবেক্ষণ, এখানে শুধু টাকা আদায়ের ঘটনা নয়—এখানে আছে ক্ষমতার ছোট ছোট দ্বীপ, যেগুলো শিক্ষাঙ্গনের ভিতর দখল করে নিয়েছে কিছু ব্যক্তি।

Manual3 Ad Code

প্রধান শিক্ষকের স্বীকারোক্তি ও ব্যঙ্গাত্মক উক্তি

বিষয়টি জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক যে কথা বলেন, তা পরিস্থিতির নাটকীয়তা আরও বাড়িয়ে দেয়।
তিনি বলেন—’আমি প্রধান শিক্ষক। সার্টিফিকেট যাকে খুশি দিতে পারি। আমি যদি না দেই, কারো কিছু করার নেই। সাংবাদিকরা যা লেখার লেখেন।’
এই বাক্য শুধু অহংকার নয়—এ যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘কর্তৃত্বের স্বেচ্ছাচারিতার’ পাঠ্যবই। একই সঙ্গে তিনি স্বীকারও করেন—প্রশংসাপত্র আটকে রাখা বেআইনি।
তবু তার বক্তব্যের ভেতর লুকিয়ে থাকে এক ধরনের বিদ্রুপ—ক্ষমতা যদি থাকে, তবে নিয়ম-কানুনের স্থান কোথায়?

লাইব্রেরিয়ান মিলনের স্বীকারোক্তি—‘এটা অপরাধ হলে হবে’

এমদাদুল হক মিলন নিজের ভাষায় সব দায় মেনে নিলেও তার অনুশোচনা নেই। তিনি জানান—তিনি ও তার স্ত্রী রুবি বাড়িতে ‘বড়দরগাহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল’ নামে কোচিং চালান। সেই কোচিংয়ের পাওনা টাকা আদায় করতেই তিনি সার্টিফিকেট আটকে রেখেছেন।
মিলনের ঝটপট মন্তব্য—”এটা অপরাধ হলে হবে। চাকরি গেলে গেল।
এ যেন শিক্ষার্থী নয়, শিক্ষকেরই ‘নৈতিক পতনের ঘোষণা’।

স্থানীয়দের ভাষায় ‘প্রতিষ্ঠান জিম্মি’

স্থানীয়রা বলেন, সার্টিফিকেট আটকে টাকা আদায়ের কারণে বিদ্যালয়ের সুনাম ধুলোয় মিশেছে। অভিভাবকেরা এখন সন্তান ভর্তি করাতে দ্বিধায়।
তাদের দাবি—মিলন প্রধান শিক্ষকের ‘আত্মীয়’ হওয়ায় তার ক্ষমতা এখানে সীমাহীন।
প্রশ্ন জাগে—শিক্ষাঙ্গনের ভেতর সম্পর্ক কি কখনো নীতিকে ছাপিয়ে যায়?

প্রশাসনের অবস্থান: শুরু তদন্তের পথ

Manual2 Ad Code

পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবাশীষ বসাক বলেন—”এমপিওভুক্ত শিক্ষক কোচিং করতে পারেন না। টাকার জন্য নম্বরপত্র আটকে রাখা সম্পূর্ণ অবৈধ। ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
জেলা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাও জানান—
‘অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হয়েছি। আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবু সাঈদ বললেন—’খোঁজ নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সমাপ্তির চিত্র—ভবিষ্যৎ জিম্মিদের প্রশ্ন

Manual5 Ad Code

পীরগাছার দামুর চাকলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ওই দালান এখনো দাঁড়িয়ে আছে।দেয়ালে ঝুলছে শিক্ষার স্লোগান—
“শিক্ষা মানুষের অধিকার।” কিন্তু বাস্তবতা যেন বলে—অধিকারের তালিকায় টাকার অঙ্কই এখন প্রধান।

সেদিনের মতো মোহারম আলী চলে যান, হাতে কাগজহীন আবেদনপত্রের কপি। তবু তার চোখে ছিল একটুখানি আলো—’কেউ না কেউ তো দেখবেই। আমার ছেলের কাগজ কেউ আটকে রাখতে পারবে না।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code