বিশেষ প্রতিনিধি
ভোর তখনো ঠিকমতো নামেনি। ঢাকা মোহাম্মদপুরের একটি মাঝারি আকারের রেস্তোরাঁর রান্নাঘরে আগুন ধরানোর শব্দে দিনের প্রথম আলো জ্বলে ওঠে। ধোঁয়া, তেল আর আদা-রসুনের গন্ধে বাতাস ভারী। কোণায় থালা মাজতে থাকা আব্দুল খালেক—দশ বছরে তিনটি রেস্তোরাঁ বদলেছেন—চুপচাপ হাত চালিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ বলেন, “ভাই, আমরা রোজ গরম আগুনের সামনে দাঁড়াই, কিন্তু আমাদের নামে একটা কাগজেও খবর নেই।” এই一বাক্য যেন সারাদেশের রেস্তোরাঁ শ্রমিকদের সংকটের মুখবন্ধ।
এক বিস্ফোরিত শিল্প, কিন্তু ভিতরে অন্ধকার!
রাজধানী, বিভাগীয় শহর, জেলা সদর-এমনকি উপজেলা পর্যন্ত রেস্তোরাঁ এখন মোড়ে মোড়ে। খাবারের গন্ধ ভেসে বেড়ায়, আলো ঝলমলে সাইনবোর্ড, দিন শেষে রাত পর্যন্ত মানুষের ভিড়। দেশের অর্থনীতিতে এই খাত যোগ করছে হাজার কোটি টাকার অবদান; ২১ লাখেরও বেশি শ্রমজীবী মানুষের জীবিকা জুড়ে আছে এই শিল্প। কিন্তু আলো যত বাড়ছে, ছায়াটাও তত লম্বা হচ্ছে—সবচেয়ে দীর্ঘ ছায়া শ্রমিকদের ওপর।
যাদের শ্রমে এই খাত বিস্তৃত হয়েছে, তাদের অধিকাংশই জানেন না নিয়োগপত্র দেখতে কেমন, কত ঘণ্টা কাজ করা আইনসম্মত, কি কি ছুটি পাওয়া যায়। যেন দেশের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল খাতটি দাঁড়িয়ে আছে শৃঙ্খলার বাইরে একটি স্বাধীন ভূমিতে—যেখানে নিয়ম-কানুন কেবল কাগজে থাকে, বাস্তবে অদৃশ্য কোনো শক্তি তা গলিয়ে দেয়।
বৈধ রেস্তোরাঁ ২.৮৫% — আর বাকিরা কার ছায়ায় চলছে?
পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, অসামঞ্জস্য যেন ইচ্ছাকৃতভাবে গড়ে ওঠা এক বড় জাল।
এনবিআরের তথ্য বলছে—দেশে ২০২৩-২৪ অর্থ বছর শেষে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে নিবন্ধিত হোটেল রেস্তোরার সংখ্যা ১৩ হাজার ৭৪৩ টি । এর মধ্যে হোটেল ৩ হাজার ১১৫ টি এবং রেস্তোরাঁ ১০ হাজার৬২৮ টি।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী দেশে হোটেল রেস্তোরাঁ সংখ্যা-৪ লাখ ৮২ হাজার। আবার বিবিএসের ২০২১ সালের জরিপ অনুযায়ী এই সংখ্যা ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪ টি।
এত বড় পার্থক্য শুধু ভুল হিসাব নয়—একটি কাঠামোগত অস্পষ্টতা। এমন অস্পষ্টতায় যেমন ভ্যাট ফাঁকি সহজ হয়, তেমনি শ্রমিকদের অধিকারও হারিয়ে যায় নজরদারির বাইরে। ৫ শতাংশ ভ্যাট হিসেবে গত অর্থবছরে মানুষজন রেস্তোরাঁয় খেয়েছেন ১০ হাজার ৫৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা-কিন্তু ভ্যাট জমা পড়েছে তার ক্ষুদ্র অংশ।
বিশ্লেষকদের মন্তব্য—”মানুষ ভ্যাট দেয়, কিন্তু কোষাগার তা পায় না”—এ যেন পুরো খাতের গোপন জলাধার, যেখানে কোটি কোটি টাকার হিসাব হারিয়ে যায়।
বিশ্লেষকরা আরও বললেন, এটি ভ্যাট ফাঁকির চক্র—যেখানে উপকারভোগী দুই দিকেই: কিছু রেস্তোরাঁ মালিক এবং তাঁদের সঙ্গে যুক্ত রাজস্ব কর্মকর্তাদের কিছু অংশ।
অফিসিয়ালভাবে কেউ বলেন না, কিন্তু অফ দ্য রেকর্ডে এটি খোলামেলা এক সত্য। রেস্তোরাঁর শ্রমঘণ্টা: আইন ৮ ঘণ্টা, বাস্তব ১২–১৪ ঘণ্টা ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম—যে শহরেই কথা বলা হোক, প্রায় একই সুর। আইন বলছে-দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ, অতিরিক্ত সময়ের ওভারটাইম ভাতা, পরিচয়পত্র, নিয়োগপত্র, বার্ষিক ছুটি, পীড়া ছুটি পাওয়া শ্রমিকের অধিকার। বাস্তবে—৯৫ শতাংশ রেস্তোরাঁয় শ্রমিকরা কাজ করেন ১০–১২ ঘণ্টা, উপজেলা শহরে ১২–১৩ ঘণ্টাও স্বাভাবিক। কোনো অতিরিক্ত ভাতা নেই, ছুটিও নেই।
একজন শ্রমিক নেতা সরাসরি বললেন—”কর্মঘণ্টা কমানো থেকে শুরু করে, মজুরি নির্ধারণ পর্যন্ত সবই মালিকরা তাদের মনগড়া আইনে চালায়। আর পরিদর্শকরা দেখেন শুধু কাগজপত্র, দেখেন না রান্নাঘরের বাস্তবতা।”
নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো—কাগজ দেখে সন্তুষ্ট, নাকি অন্য কিছু?
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (DIFE) নিয়মতান্ত্রিকভাবে এই খাতের আইন বাস্তবায়নের দায়িত্বে। কিন্তু দেশের ১০টি জেলার বিভিন্ন শ্রমিক নেতার অভিযোগ করলেন—পরিদর্শকরা ‘মাসহারা’ নেন, আর ভুয়া কাগজপত্রে সন্তুষ্ট হন, প্রকৃত চিত্র দেখার সময় যেন তাদের চোখে কুয়াশা নেমে আসে। এ যেন এক অদৃশ্য নেটওয়ার্ক—যেখানে পরিদর্শন, মালিকপক্ষ, আর রাজস্বের কিছু অংশ একে অপরকে রক্ষা করে। যে প্রক্রিয়া শ্রমিকের শ্রমকে কম দামি আর মালিকের লাভকে অদৃশ্য রাখতে সক্ষম করে তুলেছে।
অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক মো: মাহফুজুর রহমান ভুইয়াকে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন,’সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেই।’ সারাদেশের কত শতাংশ রেস্তোরায় শ্রমিকরা সুবিধা পান? ‘সে হিসাব জেলা অফিস থেকে চাওয়া হয়েছে, এলেই জানাতে পারবো।’ তাঁর উত্তরটিও যেন এই খাতের প্রতিচ্ছবি—হিসাব আছে, কিন্তু হাতে নেই, নিয়ম আছে, কিন্তু বাস্তবে নেই; তদারকি আছে, কিন্তু সত্যিকার উপস্থিতি নেই।
শ্রমিকদের আন্দোলন—লাভের সমুদ্রে নাবিকের আর্তনাদ নিম্নতম মজুরি বোর্ডের সুপারিশ ঘোষণার পর শ্রমিক সংগঠনগুলো সক্রিয় হয়েছে। বাংলাদেশ হোটেল রেস্টুরেন্ট সুইটমিট শ্রমিক ফেডারেশনের গত ২২ নভেম্বর বর্ধিত সভায় সিদ্ধান্ত—’১৪ জানুয়ারি সারাদেশে কর্মবিরতি।’
ইতোমধ্যে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। আবারও সরকারি দপ্তরে পত্র যাবে, তারপর সাংবাদিক সম্মেলন। বললেন, ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন। এ যেন এক দীর্ঘ, ক্লান্তিকর লড়াই—যার প্রতিপক্ষ কোনো এক মালিক নয়, বরং পুরো কাঠামো।
বাংলাদেশ রেস্তোরা মালিক সমিতির সভাপতি ওসমান গনি বললেন, “সব সুবিধা দেওয়া সম্ভব নয়, তবে আলোচনা করতে চাই। তারপরই তিনি যোগ করলেন—’অনেক শ্রমিককে পরিচয়পত্র দেওয়া হলেও তারা ব্যবহার করেন না। যেন দোষ চাপানো হলো শ্রমিকের ওপরই। কে লাভবান? আর ক্ষতি কার? লাভবান—ভ্যাট নিবন্ধন এড়িয়ে চলা কিছু রেস্তোরাঁ মালিক, রাজস্ব কর্মকর্তা ও শ্রম পরিদর্শন ব্যবস্থার কিছু ব্যক্তি, আর অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে বিস্তৃত ব্যবসা।
ক্ষতিগ্রস্ত—শ্রমিক: দীর্ঘ শ্রমঘণ্টা, কম মজুরি, অনিরাপদ কাজ, গ্রাহক: যে ভ্যাট দিচ্ছেন, তা রাষ্ট্রে জমা পড়ছে না। রাষ্ট্র: রাজস্ব হারায়, আইন মান্যতার সংস্কৃতি ভেঙে পড়ে এই নেটওয়ার্কে সবাই কারও না কারও আড়ালে। যেন কারও মুখে মুখোশ, কারও হাতে অদৃশ্য দড়ি—যা টানলে টান পড়বে শ্রমিকের গলায়|
শেষে খালেকের সামনে দাঁড়িয়ে যখন দুপুরের ভিড় শুরু হলো, তেল-ধোঁয়ার মধ্যে আবার দেখা গেল খালেককে। একটু আগে পর্যন্ত কারখানায় পেঁয়াজের খোসা ছাড়ছিলেন। মুখ তুলতেই দেখা গেল, চোখ লাল আর অঘোষিত ক্লান্তির চিহ্ন। কন্ঠ শুকনো। আমি জিজ্ঞেস করলাম-‘এই কাজে কি স্থায়ী হতে চাও।’ খালেক মুখ তুলে বললেন-“ইচ্ছা না থাকলেও উপায় নেই।’ বাড়িতে মা আছে, তাকে খরচ দিতে হয়।’ তার চোখের কোণে জমে থাকা ধোঁয়া আর দীর্ঘশ্বাস— সেই ধোঁয়ার ভেতরেই যেন লুকিয়ে থাকে তার ভবিষ্যৎ।
যেখানে আলো ঝলমলে সাইনবোর্ডের নিচে, রোজ জন্মায় একজন শ্রমিকের নীরব আর্তনাদ।
Sharing is caring!