জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি: রংপুরের আবাসিক এলাকায় তামাক ক্রাসিং কারখানা, প্রশাসন নীরব কেন?
লোকমান ফারুক, (রংপুর)-: বিকেলের আলো তখন সাঁঝের ছায়ায় গলে যাচ্ছিল। পাগলা পীর-ডালিয়া রোড ধরে এগোলে ধুলোমাখা বাতাসে তামাকের গন্ধ নাকে এসে বিঁধে যায়। সেই গন্ধে মিশে থাকে এক অদৃশ্য বিষ, যা প্রতিদিন ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে মানুষের দেহে—শিশুর ফুসফুসে, বয়স্কের শ্বাসে, মায়ের নিঃশ্বাসে।
একসময়ের শান্ত ও নিরিবিলি সিও বাজার থেকে পাগলা পীর-ডালিয়া রোড অঞ্চল—যেখানে একদিন সন্ধ্যা নামে পাখির ডাকে—আজ পরিণত হয়েছে এক ‘বিষাক্ত কারখানাপল্লিতে’। রংপুর শহরের এই আবাসিক ও মিশ্র আবাসিক এলাকায় এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একাধিক তামাক ক্রাসিং ও মিক্সার মিল। এই মিলগুলোয় তামাকের গুঁড়া আর রাসায়নিক কণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে ঢেকে দিচ্ছে পুরো এলাকার আকাশ। কেউ তা দেখতে পায় না, কিন্তু শ্বাস নিলে বুঝতে পারে—বাতাসে কোনো অনিষ্ট আছে।
পরিবেশবিদদের ভাষায়—’এ যেন এক নীরব গণহত্যা, যার সাক্ষী হচ্ছে রংপুরের শিশুরা।’
নীরব বসতি, বিষাক্ত বাতাস
এলাকাটিতে এখন শত শত পরিবার, হাজারো নারী, শিশু ও প্রবীণের বসবাস। স্কুলের পাশে, মানুষের জানালার ওপাশেই তামাক গুঁড়া মেশানো হয় বড় বড় মেশিনে। দিনের পর দিন সেই ধোঁয়া মিশে যায় চারপাশের বাতাসে। স্থানীয় চিকিৎসকদের মতে, শিশুদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগ ও অ্যালার্জির উপসর্গ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। কেউই সরাসরি তামাক ধরছে না, কিন্তু তার গুঁড়ো নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যাচ্ছে তাদের ফুসফুস।
গোপন কারখানার ভেতরে
মহাদেবপুর ও চওড়াপাড়া এলাকায় আলহাজ্ব আক্তার হোসেনের মালিকানাধীন এক বিশাল তামাক ক্রাসিং কারখানা—সাইনবোর্ডহীন, প্রায় ১০–১২ একর জায়গাজুড়ে। ভেতরে সারি সারি টিনশেড ঘর, যেখানে তামাক সংরক্ষণ, ক্রাসিং ও মিক্সিংয়ের কাজ চলে পুরোদমে। সরেজমিনে প্রবেশ করলে দেখা যায়, বাতাসে ভাসমান গুঁড়োতে শ্রমিকদের চোখ লাল হয়ে আছে। তাদের কেউ মাস্ক পরে না, কেউ জানে না কীসে তারা আক্রান্ত হতে পারে।
কারখানার মালিক আলহাজ্ব আক্তার হোসেনের কাছে সরকারি অনুমোদন বা পরিবেশ ছাড়পত্রের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন—
‘আমরা সবাইকে ম্যানেজ করে ব্যবসা করি। আপনারা এসেছেন, বসেন, আপনাদেরকেও সম্মান করব।’
তার অফিসের দেয়ালে কোনো অনুমোদনপত্র ঝুলতে দেখা যায়নি। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলার অনুমতি চাইলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
শ্রমিকদের জীবনের দাম
সন্ধ্যা নামার আগে কারখানার গেট খুললে দেখা যায়, শ্রমিকদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত তামাকের গুঁড়োয় ঢাকা।
১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা কাজের পর তাদের দৈনিক মজুরি মাত্র ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। যারা ক্রাসিং মেশিনে কাজ করেন, তাদের মজুরি কিছুটা বেশি—৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক বলেন, ‘এখানে কাজ করা মানে নিজের জীবনটাকে ধীরে ধীরে শেষ করা। কিন্তু পেটের দায়ে অন্য উপায় নেই।’
কারখানায় নেই কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা, নেই বায়ু পরিশোধন যন্ত্র। শুধু গুঁড়া, ধোঁয়া আর নিঃশব্দ হাহাকার।
প্রশাসনের নীরবতা, মালিকের দম্ভ।
পরিবেশ অধিদপ্তর রংপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক আব্দুস সালাম সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন— ‘আমরা বিষয়টি দেখছি।’
কিন্তু কতগুলো তামাক মিল বর্তমানে কার্যক্রম চালাচ্ছে, কিংবা কোনো মামলার তথ্য—কিছুই দিতে পারেননি।
অন্যদিকে শ্রম অফিসের উপমহাপরিদর্শক আল আমিনকে অফিসে পাওয়া যায়নি। তার অধীন কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, অধিকাংশ কারখানার কোনো বৈধ লাইসেন্স নেই, কিন্তু মন্তব্য করতে তারা ‘অনুমোদনপ্রাপ্ত নন’।
তামাক মিল মালিকের প্রকাশ্য ‘সবাইকে ম্যানেজ করার’ বক্তব্য আর প্রশাসনের এই নীরবতা—দুটো মিলিয়ে স্থানীয়দের মনে প্রশ্ন, ‘এখানে আইন ঘুমাচ্ছে, না কি তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে?’
নীরব মৃত্যুর ছায়া
বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে মৃত্যু হয় প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের। আরও ১৫ লক্ষাধিক মানুষ ভুগছেন ফুসফুস ক্যান্সার, মুখগহ্বর ক্যান্সার, হৃদরোগ ও স্ট্রোকে। রংপুরের এই এলাকাগুলোয় সেই মৃত্যুর ছায়া নেমে এসেছে অন্যভাবে—নিঃশ্বাসে বিষ ঢুকে যাচ্ছে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শরীরে রোপিত হচ্ছে রোগের বীজ।
বিকল্পের পথ ও নৈতিক প্রশ্ন
পরিবেশবিদরা বলছেন, ‘জনবসতিপূর্ণ অঞ্চল থেকে এই তামাক কারখানাগুলো অবিলম্বে সরিয়ে নেওয়া জরুরি। স্থানীয় সরকার চাইলে এক নির্দিষ্ট শিল্পাঞ্চলে তাদের স্থানান্তর করে দিতে পারে।’ তারা আরও প্রস্তাব করেন—’অঞ্চলটিতে একটি ‘স্বাস্থ্যবান্ধব পার্ক’ গড়ে তোলা যেতে পারে, যেখানে আজ শিশুদের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।’
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—যখন প্রশাসনের চোখের সামনেই বিষ তৈরি হয়, তখন নীরব থাকা কি প্রশাসনিক শালীনতা, নাকি নৈতিক পরাজয়।
শেষ দৃশ্য
সন্ধ্যার আলো তখন নিভে যাচ্ছে, বাতাসে ভাসছে তামাকের তীব্র গন্ধ। দূরে কোনো শিশুর কাশি শোনা যায়। মনে হয়, এই শহর যেন নিজেই নিজের শ্বাসরোধ করছে—নীরবে, ধীরে, প্রতিদিন।
৩ নভেম্বর ২০২৫
Sharing is caring!