বিশেষ প্রতিনিধি
ভোরের আলো ফুটলেও কুড়িগ্রামের আকাশ যেন আলো গ্রহণ করতে ভুলে গেছে। সীমান্তঘেঁষা এই জনপদের ওপর নেমে এসেছে এক ঘন, ভেজা শীতের পর্দা। রাস্তা, জমির আইল, ঘাট—সবখানেই বাতাসে কাঁপন ধরানো হিমেল পরশ। বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় রাজারহাট পর্যবেক্ষণাগারে রেকর্ড হলো—১২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই মৌসুমের প্রথম বড় শীতেই জনজীবন প্রায় থমকে গেছে।
কুয়াশার চাদর এমন ঘন যে সকালেও সামনে কয়েক হাত দূরত্ব দেখা যায় না। সড়কে চলতে গিয়ে তাই মোটরসাইকেলচালক থেকে ট্রাকচালক—সবাইকে হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরগতিতে এগোতে হচ্ছে। শীত শুধু দৃশ্যকে নয়, থমকে দিয়েছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে।
যাত্রাপুর ইউনিয়নের এক বাসিন্দার কণ্ঠে ভেসে উঠল বাস্তবতার শীতলতা—’কুয়াশায় কিছুই দেখা যায় না। বাড়িত থাকি বের হওয়া যায় না। কিন্তু খামু কী? খাওয়া লাগবে তো?’
দিনমজুরদের কথায় স্পষ্ট—শীত তাদের কাছে শুধু আবহাওয়ার পরিবর্তন নয়, জীবিকার অনিশ্চয়তা।
পৌর শহরের রিকশাচালকরা তো আরও চিন্তিত। এক চালক বললেন, ‘ঠান্ডায় মানুষই নাই রাস্তায়। ভাড়া পাই না। ঘর থেকে বের হইছি, কিন্তু ভাড়া নাই। সংসার কীভাবে চলবে ভাবছি।’
যেন কুয়াশায় ঢাকা শুধু সড়ক নয়, ঢাকা পড়ে গেছে হাজারো নিম্নআয়ের মানুষের আগামী দিনটিও।
রাজারহাট আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার জানালেন, ‘আজ সকাল ৬টায় জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পরিস্থিতি আরও ঠান্ডার দিকে যেতে পারে।’
তার এই সামান্যতম ইঙ্গিতই যেন জানান দিল—এ শীত অস্থায়ী নয়, আরও ক’দিন আঁকড়ে ধরবে উত্তরের এই জেলা।
দিন যত এগোয়, কুয়াশা কিছুটা পাতলা হয় বটে, কিন্তু মানুষের মুখে ঘন হয় অনিশ্চয়তার রেখা। খেটে-খাওয়া মানুষের জন্য শীত মানে অতিরিক্ত পোশাকের প্রয়োজন, সাথে কমে যাওয়া আয়ের সামনে দাঁড়িয়ে টিকে থাকার লড়াই। ঠিক যেমন ভোরের কুয়াশা—একদিকে সুন্দর দৃশ্য, অন্যদিকে জীবনযুদ্ধে বাধা।
কুড়িগ্রামের শীত এদিন তাই কেবল তাপমাত্রার সংখ্যা নয়, ছিল মানুষের সংগ্রাম; অপরিকল্পিত বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শত শত পরিবারের শীতল গল্প।
এই শীত—একদিনের নয়; এটি সেই টানটান বাস্তবতা, যার ভেতর দিয়েই বেঁচে থাকার গল্প লিখছে কুড়িগ্রামের মানুষ।
Sharing is caring!