৩১শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৫ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৯ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

রংপুর শ্রম দপ্তরে সহকারীর রাজত্ব: আদালতে মামলার অজুহাতে ঘুষ বাণিজ্য

admin
প্রকাশিত অক্টোবর ১৮, ২০২৫, ০৬:০২ অপরাহ্ণ
রংপুর শ্রম দপ্তরে সহকারীর রাজত্ব: আদালতে মামলার অজুহাতে ঘুষ বাণিজ্য

Manual3 Ad Code

ডেস্ক রিপোর্ট

রংপুরের আর কে রোড, গণেশপুর। বহুতল ভবনের নিচতলায় লেখা—’আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, রংপুর।’ কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায়, এটি কেবল সরকারি দপ্তর নয়; এ যেন দুর্নীতির এক পরিপাটি মঞ্চ—যেখানে ফাইলের শব্দ মিশে যায় টাকার গন্ধে, আর ক্ষমতার রাজ্যে রাজত্ব করেন এক ‘অফিস সহকারী’—ছাবদার হোসেন।

দপ্তরের ভেতরে সকালের সূর্যের আলো ঢোকে না ঠিকঠাক, কিন্তু ছাবদারের ডেস্কে ঢোকে শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধি, নেতা, দালাল, এমনকি শ্রমিকের প্রতিনিধি হয়ে ওঠা কোন ব্যবসায়ী! সবাই চায় তার ‘সিলমোহর’ কারণ, এখানেই এখন সিদ্ধান্ত হয়— কে নির্বাচনে দাঁড়াবে, কার কমিটি বৈধ, আর কার ফাইল হারিয়ে যাবে চুপিচুপি।

রংপুর জেলা ট্রাক ও ট্যাংক লরি শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি. নং রাজ–৯২১)-এর ভোটার তালিকা নিয়ে প্রবীণ শ্রমিকদের ঘোর আপত্তি, তালিকায় ভুয়া নাম, দ্বৈত সদস্য, আর বহিরাগত প্রতিনিধি। তবুও ওই অভিযোগ নিস্পত্তির আগেই ২০২৫ সালের ২ জানুয়ারি সাধারণ সভা আহবান করেন নির্বাহী কমিটি।

শ্রম দপ্তরের সভা তত্ত্বাবধানকারী কর্মকর্তারা লিখিত প্রতিবেদনে জানান—’সভার কোরাম হয়নি, উপস্থিত অনেকেই প্রকৃত শ্রমিক নন।’ তা সত্বেও নির্বাহী কমিটি সেই অবৈধ সভায় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করে, ভোট নেয়, ফল প্রকাশ করে এবং শ্রম দপ্তরে জমা দেন।

৪ মার্চ ২০২৫—দপ্তর সেই প্রতিবেদন যাচাই করে নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন। নির্দেশ দেয়, ৩০ দিনের মধ্যে পুনঃনির্বাচন দিতে। কিন্তু নির্বাচিত কমিটি শ্রম আদালতের দ্বারস্থ হয়। আর সেই অজুহাতে দপ্তরের সবকিছু থমকে যায়। তদন্তে দেখা গেছে, আদালত কোনো স্থগিতাদেশ দেয়নি তা জেনেও, দপ্তরের উপপরিচালক তুষার কান্তি নিজের অফিস আদেশ স্থগিত রাখেন।

Manual1 Ad Code

একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন—’ছাবদারের পরামর্শেই অফিস থেমে গেছে। তিনি না বললে কিছুই হয় না।’

এই অফিস থেকেই ছাবদারের হাত ধরে কুড়িগ্রাম জেলা অটো টেম্পু ও সিএনজি শ্রমিক ইউনিয়নে গঠিত হয় এক রহস্যময় কমিটি—নাম ‘কো-অপট কমিটি’। মেয়াদোত্তীর্ণ নির্বাহী কমিটির বিপরীতে মৌখিক অনুমতিতে তৈরি এই কমিটি এখন চালাচ্ছে, সদস্যপদ হালনাগাদ, ফি আদায় এবং পরিচয়পত্র বিতরণের কাজ।

Manual5 Ad Code

ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ বলেন—”আমরা সাধারণ সভার তারিখ নির্ধারণ করে পত্র দিতে গিয়ে দেখি, আমাদের দুজন সদস্য ছাবদারের পাশে বসে আছেন। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই পূর্ব থেকে তৈরি করা রেজুলেশনে আমাদের স্বাক্ষর নেওয়া হয়।

Manual6 Ad Code

মৌখিকভাবে ‘কো-অপট কমিটি’ ঘোষণা করেন ছাবদার হোসেন, অজুহাত আমাদের কমিটি মেয়াদ উত্তীর্ণ।’ পরে শুনি ৮০ হাজার টাকায় মৌখিক অনুমোদন পেয়েছে তারা।’ যোগাযোগ করা হলে ‘কো-অপট কমিটি’র নেতারা টাকা দেওয়ার কথা অস্বীকার করলেও কমিটি গঠনের কথা স্বীকার করেন।

উপপরিচালক তুষার কান্তিকে রংপুরের ট্রাক ও ট্যাংক লরি শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বললেন, ‘কোর্টে মামলা আছে, তাই কিছুই করার নেই।’ তবে আদালতের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই—এ তথ্য জানানো হলে, তিনি নিরব থাকেন।

ছাবদারের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি সংক্ষিপ্ত উত্তর দেন— ‘ছাবদারকে নিয়ন্ত্রণে আমি ব্যর্থ, এটা ঠিক নয়।’ দপ্তরের এক কর্মকর্তা বললেন, ‘এখানে এখন এমন অবস্থা—উপপরিচালক ফাইল সই করেন, কিন্তু নির্দেশ দেয় ছাবদার।’

রংপুরের একজন প্রবীণ ট্রাক চালক জানালেন— ‘আমরা প্রয়োজনে সারারাত গাড়িতে ঘুমাই, তেল ধোঁয়ায় কাজ করি। ইউনিয়নের অফিসে গেলে মনে হয়,শ্রমিকের দাম শুধু ভোটের সময় বাড়ে। বাকি সময় আমরা কাগজে বন্দি।’

Manual3 Ad Code

একজন বিশ্লেষক মন্তব্য করেন, ‘শ্রম দপ্তর এখন শ্রমিকের ঘাম নয়, ঘুষের উপর দাঁড়ানো এক দপ্তর। যেখানে আইন নয়, চলে ‘লেনদেনের সংবিধান।’

একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক বলেছিলেন,’সত্যকে ঢেকে রাখা যায় কিছু সময়ের জন্য, কিন্তু ক্ষমতার গন্ধ শেষমেশ বেরিয়ে পড়েই।’ রংপুরের শ্রম দপ্তরে এখন সেই গন্ধ ছড়িয়ে আছে বাতাসে।

একজন অফিস সহকারীর টেবিল থেকে নির্ধারিত হচ্ছে ইউনিয়নের ভাগ্য, একটি দপ্তরের ছায়ায় গড়ে উঠছে রাজত্ব—যেখানে শ্রমিকদের ঘাম পুড়ে যায় চুল্লিতে, আর ঘুষের ধোঁয়ায় আড়াল হয় সত্য।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code