১৯শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২১শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

পরিত্যক্ত বোমা নিষ্ক্রিয় করতে ডুবুরি রোবট ব্যবহার করছে জার্মানি

admin
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৫, ০৬:৩২ অপরাহ্ণ
পরিত্যক্ত বোমা নিষ্ক্রিয় করতে ডুবুরি রোবট ব্যবহার করছে জার্মানি

জার্মানির উত্তরের লুবেক উপসাগরে একটি বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ অভিযান চলছে। এই অভিযানের মাধ্যমে সমুদ্রের তলদেশে কোনো গুপ্তধন বা শিকার খোঁজা হচ্ছে না। বরং ডুবুরি রোবটের সাহায্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিত্যক্ত নৌ মাইন, টর্পেডো, গোলাবারুদ এবং বিমান বোমা নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করছে জার্মান এক বিশেষায়িত দল।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে অভিযান চালিয়ে সমুদ্রের তলদেশ থেকে প্রায় ৮০ বছর পুরোনো বিস্ফোরক সরানোর কাজ করেছেন পরিবেশবিদেরা। এ কাজে তারা আধুনিক ডুবুরি রোবট ব্যবহার করছে। এই রোবটগুলোতে শক্তিশালী ক্যামেরা, আলো এবং সেন্সর রয়েছে, যা সমুদ্রের নিচে বিস্ফোরক বস্তু শনাক্ত করতে পারে। পরবর্তীতে, এগুলো তুলে আনার জন্য বৈদ্যুতিক চুম্বক বা হাইড্রোলিক এক্সকাভেটর ব্যবহার করা হয়, যাতে বিস্ফোরণের ঝুঁকি কমে যায়।

এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিষাক্ত বর্জ্য পরিষ্কার করা, যা বাল্টিক ও উত্তর সাগরের তলদেশে ছড়িয়ে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, শুধু জার্মান সমুদ্রেই প্রায় ১৬ লাখ টন যুদ্ধাস্ত্র ফেলে দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক অস্ত্রও রয়েছে।

জার্মান পরিবেশমন্ত্রী স্টেফি লেমকে বলেন, ‘এটি কয়েকটি অবিস্ফোরিত বোমা নয়, আমরা কথা বলছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় কোটি কোটি যুদ্ধাস্ত্রের ব্যাপারে, যা উদ্দেশ্যমূলকভাবে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে।’

পরিবেশগত ক্ষতির দিকে নজর না দিয়েই অস্ত্রগুলো দ্রুত নিষ্ক্রিয় করার জন্য স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সাহায্যে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। এই অস্ত্র ফেলার কাজ প্রধানত ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে ঘটেছিল।

এই বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়করণ উদ্যোগটি প্রথমদিকে তেমন কোনো গুরুত্ব পায়নি। তবে আধুনিক গবেষণায় জানা গেছে, এসব যুদ্ধাস্ত্রের বর্জ্য পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা পানির মধ্যে টিঅ্যান্ডটির মতো বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন, যা স্থানীয় মৎস্য ও জীবের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেন জার্মানির কিল শহরের শ্লেসভিগ-হোলস্টেইন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের বিষবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ এডমুন্ড। জার্মানির লুবেক উপসাগরে কাছে ঝিনুক ও মাছের মধ্যে টিএনটির উপস্থিতি পেয়েছেন তিনি। তাঁর গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, যুদ্ধজাহাজের কাছাকাছি বাস করা মাছগুলোর মধ্যে যকৃতের টিউমার এবং অঙ্গের ক্ষতির হার অনেক বেশি।

পোলিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের বিশেষজ্ঞ জেসেক বেলডোস্কি বলেন, প্রচলিত গোলাবারুদ ক্যানসার সৃষ্টিতে অবদান রাখে। আর রাসায়নিক অস্ত্র জিনগত পরিবর্তন ঘটাতে পারে এবং এনজাইমের কার্যক্রম বিঘ্নিত করে, যা সামুদ্রিক প্রাণীদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

২০১৮ সালের আরেকটি গবেষণায় জার্মান উপকূলের পানির ৯৮ শতাংশ নমুনায় বিস্ফোরক পদার্থ পাওয়া গেছে। এ ধরনের দূষণের মাত্রা উদ্বেগজনক। বর্তমানে পানিতে রাসায়নিকের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম হলেও এই সমস্যা অবহেলা করা হলে পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হতে পারে।

১০০ মিলিয়ন ইউরো ব্যয়ে এই প্রকল্প চালাচ্ছে জার্মানি সরকার। এই প্রকল্পে উদ্দেশ্য হলো নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে মৎস্যজীবীদের জন্য বিপদমুক্ত এবং কার্যকর পদ্ধতিতে বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করা।

এই প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিচ্ছে ‘সিটেরা’ এবং ‘এগার্স কাম্পফমিতেলবেরগুং’ নামের কোম্পানিগুলো। এরা নতুন প্রযুক্তি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করছে।

পরবর্তী ধাপে সমুদ্রতলের বিস্ফোরক নিরাপদভাবে নিষ্ক্রিয় করার জন্য একটি ভাসমান নিষ্ক্রিয়করণ কেন্দ্র স্থাপন করা হবে, যা বিস্ফোরকগুলো তীরে নিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দেবে।

এই বিশেষ অভিযান পরবর্তী পর্যায়ে স্বয়ংক্রিয় ডুবুরি রোবট ব্যবহার করে অস্ত্র ও বিস্ফোরক শনাক্ত, স্ক্যান, চুম্বকীয় চিত্রায়ণ এবং শ্রেণিবদ্ধকরণের মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে নিষ্ক্রিয় করার লক্ষ্য নিয়েছে।

এটি শুধু জার্মানির জন্য নয়, বরং সমগ্র ইউরোপের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ এটি উপকূলীয় অঞ্চলগুলোকে দূষণমুক্ত এবং নিরাপদ রাখতে সাহায্য করবে।

Sharing is caring!