২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩শে জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

সুরমা পারের অশ্বারোহী

admin
প্রকাশিত নভেম্বর ২৫, ২০২৪, ১০:৩৯ পূর্বাহ্ণ
সুরমা পারের অশ্বারোহী

️সুরমা পারের অশ্বারোহী▪️
(সূচনা পর্ব)
“”””””””””””””””””””””””””””””””””””
সিরাজুল ইসলাম
“”””””””””””””””””””””””””””””””””””

এক॥
ছাতক-দোয়ারার বুক ছিড়ে বহমান দেশের অন্যতম নদী সুরমা। সুরমা তীরের মানবজমিন এক সমৃদ্ধ জনপদ। পথে প্রান্তরে অপরূপ সৌন্দর্য্য। প্রাকৃতিক বৈচিত্রের অপূর্ব লীলাভূমি। সুরমা বিধৌত পলল ভূমির দু’কূল জুড়ে বিস্তৃত নয়নাভিরাম দৃশ্য যে কারো হৃদয় জয় করবে।

দুই ॥
হৃদয় জয়। হ্যাঁ, হৃদয় জয়ের গল্প। নানাজনের গল্প নানারূপ হয়। তবে এ গল্প কোটি মানুষের হৃদয় জয়ের গল্প।

তিন॥
ফেব্রুয়ারি মাস, উনিশশত একানব্বই সাল। পড়ন্ত বিকেল! এক অপূর্ব বিকেল! সালাতুল আসর শেষে বন্ধুদের সাথে গ্রামের প্রধান সড়ক ধরে হাঁটছি। শেষ বিকেলের অঝোর কান্না শুরু না হলেও রক্তলাল সূর্য পশ্চিমাকাশে কিঞ্চিৎ হেলে পড়েছে। লালিমা আভার স্ফুরনে কি যে এক অপরূপ দৃশ্য! একটু পরেই নামবে সন্ধ্যা। হালকা শীতল বাতাসের পরশে শিহরিত দেহ-মন। তখন চিরায়ত বাংলার গ্রামীণ পরিবেশে জাতীয় নির্বাচনের আমেজ তুঙ্গে, চলছে নির্বাচনী ডামাডোল। আমাদের মুখে নির্বাচনী খই ফুটছে। এমন সময় দেখা গেলো অনেকটা দ্রুত গতিতে আসছে একটি ঘোড়া। পিঠে এক সিংহ শার্দুল সওয়ারী। চাবুকের শপাং শপাং আওয়াজ নেই। আছে অশ্ব খুরের খট খট শব্দ। প্রধান রাস্তা জুড়ে ধুলো উড়ছে। ধূলি ধূসর বাতাসে শন শন বেগে ছুটছে ঘোড়া। অশ্বারোহী হাত নেড়ে দৃষ্টি আকর্ষন করলেন। আমরা অভিবাদন জানিয়ে সায় দিলাম। অনেকটা রাজকীয় ও অভিজাত ভঙ্গিমায় আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে গেলেন অশ্বারোহী। ঘোড়ায় আরোহী সওয়ার এক স্বপ্নীল পুরুষ। তাগড়া, নওজওয়ান। তার দেহ-মনে ছুটে চলার ক্লান্তি নেই। আত্মপ্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাসের ছাপ তার অবয়বে। শুভ্র সফেদ পাজামা, পাঞ্জাবী, টুপি পরিহিত পরিপাটি এক অনন্য মানব। আকর্ষণীয় চেহারার দ্যোতি ছড়িয়ে আমাদের পেরিয়ে গেলেন। আমরাও ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে তাকিয়ে অনেকটা অবাক বিস্ময়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার পানে চেয়ে রইলাম। ধূসর প্রান্তরের মেঠোপথ থেকে অশ্ব খুরের খট্ খট্ আঘাতে উড়ে আসা ধুলোর ঘ্রাণে ক্ষণিকের জন্য মাতোয়ারা ও আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। সেদিনের অশ্বারোহীই আজ কোটি হৃদয়ের রাজপুত্র।

চার ॥
বলছিলাম সুরমা তটের পথে-ঘাটে-মাঠে, প্রান্তরে-তেপান্তরে চষে বেড়ানো সেই ঘোড় সওয়ারের কথা। সুরমা পারের অশ্বারোহীর কথা! তিনি আর কেউ নন, তিনি আমাদের সালাম মাদানী। পুরো নাম এটি.এম. আব্দুস সালাম। সেদিন তিনি ক্ষণিকের জন্য আসলেন। তীব্র বেগে ছুটে চললেন জনে জনে। হৃদয় জয় করলেন। জনগণের ভালবাসায় সিক্ত হলেন। সেই যে একানব্বই সালে পথ চলা শুরু হয়েছিল, আজও তিনি থেমে নেই। কাজ করে যাচ্ছেন অবিরত। আজ তিনি কোটি হৃদয় জয় করে এক সার্থক পুরুষ। মূলত: হৃদয় জয়ের এই গল্পকে সমৃদ্ধ ও সফল করেছে তার বহুমাত্রিক গুণাবলী ও চারিত্রিক মাধুর্য্য।

পাঁচ ॥
বলতে দ্বিধা নেই- সালাম মাদানী বহুমাত্রিক গুণাবলীর আধার। অনিন্দ্য সুন্দর মাঝারী গড়নের দেহাবয়ব, হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, তীক্ষ্মজ্ঞান, মেধা, যোগ্যতা, প্রখর স্মৃতিশক্তি ও প্রতিভার তরঙ্গমালা তাকে করেছে অনন্য। তিনি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও পেশাগত জীবনে এক সফল ব্যক্তিত্ব। মানুষ গড়ার এক মহান কারিগর, আদর্শ শিক্ষক ও দক্ষ শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে সমাদৃত। ধর্মীয় ও আধুনিক অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার ছোঁয়ায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তিনি শিক্ষা বিস্তার ও ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক, খ্যাতিমান আলেমে দ্বীন ও অসংখ্য আলেমের ওস্তাজ। তিনি বাগ্মী ও সুবক্তা। তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় উচ্চারিত বলিষ্ঠ কণ্ঠধ্বনি যখন ইথারে ইথারে ঝংকৃত হয়, তখন আলোড়িত হয় মুমিনের হৃদয়, বিগলিত হয় পাপিতাপি আত্মা, শ্রোতার প্রতিটি রক্ত কনিকা জেগে উঠে, আর আতংকিত হয় তাগুতি শক্তি। অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার, বিদাত, ব্যক্তিপূজা ও মাজার পূজার ধারক ও বাহকদের মূর্তিমান এক আতংকের নাম সালাম মাদানী। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক প্রচন্ড দ্রোহ, সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে আপোষহীন ও সত্যের পথে অটল-অবিচল। হযরত আবু বকর রা. যেমন মুমিনদের জন্য ‘রূহামায়ু বাইনাহুম” এবং কাফিরদের জন্য ‘আশিদ্দায়ু আলাল কৃষ্ণার’ চরিত্রের ছিলেন, তেমনই সালাম মাদানী একই চিন্তা-চেতনায় উদ্বুব্ধ মানুষ। তিনি সৎ, সাহসী, নির্ভিক, নির্লোভ ও দুর্জয়ী। আমানতদার ও ন্যায় পরায়ন সালিশী ব্যক্তি হিসেবে তার সর্বজন গ্রাহ্যতা সর্বমহলে। তিনি মহান দ্বীনের এক একনিষ্ঠ দায়ী, ইসলামী আন্দোলনের সিরাজাম মুনির, ইসলামী সমাজ বিপ্লবের এক অকুতোভয় সৈনিক ও আদর্শ রাজনীতিবিদ। সালাম মাদানী তৃণমূল রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। তিনি ইসলামী ঐক্য প্রচেষ্টার ঐকান্তিক কর্মী। বলা না বলা, ব্যক্ত-অব্যক্ত, প্রকাশিত-অপ্রকাশিত হৃদয়জ গুনাবলীর কারনে তিনি মা, মাটি ও মানুষের সাথে মিশে আছেন। পরশ্রীকাতর, প্রতিহিংসাপরায়ন, নষ্ট-ভ্রষ্ট রাষ্ট্রযন্ত্রের কুটিল নীল নক্সায় কোটি হৃদয়ের এই রাজপুত্রকে বাতিলের জিন্দানখানায় বন্দী হতে হয়েছে। কারাবরণ করতে হয়েছে বার বার। তবুও তার আদর্শচ্যুতি হয়নি। ঈর্ষনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী সালাম মাদানী উচ্চ শিক্ষিত ও পন্ডিত হলেও তার সহজ-সরল, নিরহংকার, সাধাসিধে জীবন যাপন সবাইকে আকৃষ্ট করে। তার চলন-বলন-কথনে ঝড়ে পড়ে প্রাণ চঞ্চলতা। বিনয় ও মধুর ব্যবহার তার সহজাত ভূষন। শুধু স্বদেশ নয়, আরব জাহান ও পশ্চিমা মুল্লুকসহ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে আছে এই দিগ্বিজয়ী অশ্বারোহীর সুনাম ও সুখ্যাতি।

(চলবে…..)

 

সুরমা পারের অশ্বারোহী◾

(সমাপনী পর্ব)
“””””””””””””””””””””””””””””””””””””
সিরাজুল ইসলাম
“””””””””””””””””””””””””””””””””””””

 

ছয়॥
শত ব্যাথা, দুঃখ-যাতনার মাঝেও সালাম মাদানীর হাস্যরস সহযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত ও উৎফুল্ল করে, অনুপ্রাণিত করে। তার পছন্দ ও অপছন্দে রয়েছে বৈচিত্র্যতা। তার লালিত স্বপ্ন: খোদার রাজ্যে খোদার রাজত্ব কায়েম। স্মরণীয় ক্ষণ: বাবার সাথে একশত টাকা ভাড়ায় বিমানে সিলেট থেকে ঢাকা যাত্রা। আবেগঘন মুহুর্ত: স্কলারশীপ পেয়ে মদীনা গমন ও রাওদায়ে আতাহারের প্রথম জিয়ারাহ। তার প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব: আমীরে জামায়াত। আল্লামা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদী রাহি, তার পছন্দের বক্তা। প্রিয় লেখক: নসীম হিজাযী। কবি হিসেবে তার পছন্দের তালিকায় রয়েছেন: আল্লামা ইকবাল, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ ও আল মাহমুদ। প্রিয় শিল্পী: মতিউর রহমান মল্লিক। অবসর কাটে: বই পড়ে ও পরিবারে সময় দিয়ে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি রয়েছে বিশেষ টান। শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের তিনি ভালবাসেন। তার মাঝে বিরাজিত আছে সুপ্ত লেখক সত্তা।

 

সাত ॥
সালাম মাদানীর জীবন ও কর্ম সংশ্লিষ্ট একটা বিখ্যাত হাদিসের উদ্ধৃতি খুবই প্রাসঙ্গিক। সহীহ আল বুখারি ১ম খন্ডের কিতাবুল অহী অংশের তিন নম্বর হাদীসের মধ্যভাগের বর্ণনা ” পরে তাঁর (রাসুল সা. এর) ভয় চলে গেলে তিনি খাদিজা (রা.) এর নিকট সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, আল্লাহার কসম! আমি আমার নিজের জীবন সম্পর্কে আশংকাবোধ করছি। খাদিজা (রা.) শান্তনা দিয়ে বললেন, না, ভয় নেই। আল্লাহর কসম! তিনি কখনোই আপনাকে অপমানিত করবেন না। কারন আপনি নিজ আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, দুর্বল ও দুঃখীদের খেদমত করেন, মেহমানদারী করেন এবং সত্য পথের বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করেন………”

 

আট॥
প্রতিটি মুমিন বান্দা মহান আল্লাহার দাসত্ব ও তাঁর রাসুল স. এর জীবন, চরিত্র ও কর্মের অনুসরণ করে থাকে। সে হিসেবে বর্ণিত হাদিসের মূল্যবান কথামালার সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে সালাম মাদানীর ব্যবহারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জিন্দেগীতে। তিনি তার আত্মীয়-স্বজনদের হক আদায়ে সদা তৎপর। দুর্বল, গরীব-দুঃখী ও মেহনতি মানুষের খেদমতে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছেন। আতিথেয়তাপরায়ণ মাদানী মেহমানদারীতে আন্তরিক ও উদার। বিপদগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো তার সহজাত প্রবৃত্তি। বস্তুত: সালাম মাদানী খেদমতে খালকের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। ‘চাঁনপুরের চাঁদ’ সালাম মাদানী স্নিদ্ধতার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন সর্বত্র। ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ স্লোগানের প্রকৃষ্ট উদাহরণ তিনি। মানব সেবার মহান ব্রত নিয়ে তার সরব পদচারনায় উপকৃত হচ্ছে দেশের অসহায় নারী, শিশু, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা। দিনের বেলায় সংগ্রামী ও রাতের আঁধারে দরবেশ মনীষার এই মানুষটি আর্তমানবতার সেবায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ছুটে গিয়েছেন। যেখানে মানবতা দুর্বিপাকে সেখানেই সালাম মাদানী। দুর্যোগে-দুর্ভোগের এই অতন্দ্র প্রহরী উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো ও আইলায় আক্রান্তদের সহযোগিতায় ছুটে গিয়েছেন। বাইশের বন্যায় সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলায় মাসব্যাপী নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে মানব সেবায় কাজ করেছেন। অসহায় মানুষের জন্য তার মন কাঁদে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ঘরে ঘরে গিয়েছেন সাহায্য নিয়ে। সাম্প্রতিক ঘুর্ণিঝড়, শিলাবৃষ্টি ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য সাহায্য নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন। অসহায় মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন নিরবধি।

 

নয় ॥
সালাম মাদানীর জীবন ও কর্ম উম্মাহ ও মানবতার কল্যাণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। তিনি আমাদের প্রেরণার বাতিঘর। মহান আল্লাহ তাকে বর্তমান ঝঞ্চাবিক্ষুব্ধ কঠিন সময়ে উত্তাল সমুদ্রে উম্মাহর দক্ষ নাবিক হিসেবে কাজ করার তাওফিক দিন, তাকে হায়াতে তায়্যিবা দান করুন। আমীন।
(সমাপ্ত)

 

[লেখক: অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, সিলেট-সুনামগঞ্জ]

Sharing is caring!