১৯শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৮শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

হাদির খুনিদের গ্রেপ্তার দাবিতে রংপুরে বিক্ষোভ, লাঙ্গল প্রতীক ভাঙচুর

admin
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১৯, ২০২৫, ১০:০০ অপরাহ্ণ
হাদির খুনিদের গ্রেপ্তার দাবিতে রংপুরে বিক্ষোভ, লাঙ্গল প্রতীক ভাঙচুর

Manual1 Ad Code

লোকমান ফারুক, রংপুর

রাত তখনও গভীর হয়নি। শহরের বাতাসে শীতের কুয়াশার সঙ্গে মিশে আছে ক্ষোভ। খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই—একটি নাম, একটি মৃত্যু—রংপুর যেন হঠাৎ জেগে ওঠে।

Manual2 Ad Code

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী শরীফ ওসমান বিন হাদি আর নেই—এই সংবাদটি মুহূর্তেই সাধারণ ছাত্র-জনতার ভেতর আগুন জ্বালিয়ে দেয়। যে শহর দিনের আলোয় শান্ত, রাত নামতেই সেখানে স্লোগান হয়ে ওঠে শোক, শোক হয়ে ওঠে প্রতিরোধ।

বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাত সোয়া ১১টার দিকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে জমায়েত হয় ইনকিলাব মঞ্চের নেতাকর্মী, জুলাই আন্দোলনকারী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

সেখান থেকেই বের হয় বিক্ষোভ মিছিল। কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে ওঠে—”বিচার চাই, হাদি হত্যার বিচার চাই,” “আর নয় প্রতিরোধ, এবার হবে প্রতিশোধ” , “তুমি কে আমি কে? হাদি হাদি” —স্লোগানগুলো যেন শুধু শব্দ নয়, সময়ের সঙ্গে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

নগরপথে ক্ষোভের পদচিহ্ন

মিছিলটি পার্কের মোড়, শহীদ আবু সাঈদ চত্বর, মডার্ন মোড় ও লালবাগ পেরিয়ে কলেজ রোড হয়ে শাপলা চত্বরে গিয়ে থামে। পথে পথে মানুষ যোগ দেয়—কেউ শিক্ষার্থী, কেউ পথচারী, কেউ রাজনৈতিক কর্মী। শহরের সড়ক যেন সাক্ষী থাকে এক সমবেত ক্রোধের।

শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য দেন ইনকিলাব মঞ্চের নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। বেরোবির শিক্ষার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক জাহিদ হাসান জয় বলেন, ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়—যারা ফ্যাসিবাদ ও জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তাদের হত্যার নীলনকশা আগে থেকেই আঁকা হয়ে থাকে, হাদিকেও সেভাবেই হত্যা করা হয়েছে,” বলেন তিনি। তাঁর কণ্ঠে ছিল শোকের ভার, আর কথায় রাজনৈতিক প্রত্যয়—দেশের মাটি, মানুষ ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে হাদি ‘নতুন বন্দোবস্তের’ স্বপ্নের সারথি হয়ে থাকবেন।

Manual4 Ad Code

অভিযোগ, দাবি ও নৈতিক প্রশ্ন

Manual4 Ad Code

জুলাই আন্দোলনের অগ্রসারির কর্মী রহমত আলী আরও কঠোর ভাষায় কথা বলেন। তাঁর দাবি, “মধ্যযুগীয় কায়দায় মাথায় গুলি করে হাদিকে হত্যা করা হয়েছে।” তিনি অভিযোগ তোলেন, “আওয়ামী লীগ ও ভারতের যৌথ পরিকল্পনার কথা, এবং হুঁশিয়ারি দেন—অপরাধীরা দ্রুত গ্রেপ্তার না হলে সরকারের নৈতিক বৈধতা প্রশ্নের মুখে পড়বে।

কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল নোমান ভারতের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তাঁর ভাষায়, “ভারত যদি বন্ধু রাষ্ট্র হয়, তবে খুনিরা সেখানে নিরাপদ আশ্রয় পায় কীভাবে?”—এই প্রশ্নে ভিড়ের ভেতর থেকে ওঠে সমর্থনের গর্জন। হাদি এখানে কেবল একজন ব্যক্তি নন; তিনি হয়ে ওঠেন “বিপ্লবের প্রতীক, সাহসের বাতিঘর।”

ভাঙচুরের মুহূর্ত

প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে মিছিলটি শাপলা চত্বর থেকে ফেরার পথে নগরীর খামার এলাকায় গেলে উত্তেজিত স্লোগান ধারীদের কেউ কেউ মেয়র মোড়ে লাঙ্গল প্রতীক ভাঙচুর করে । মুহূর্তটির নাটকীয়তা শহরের রাজনৈতিক উত্তাপকে আরও দৃশ্যমান করে তোলে—ক্ষোভ যখন প্রতীকে আঘাত হানে, তখন তা কেবল প্রতিবাদ নয়, বার্তা।

শহরজুড়ে সমান্তরাল বিক্ষোভ

Manual2 Ad Code

রাত ১২টার দিকে নগরীর সেন্ট্রাল রোডে জাতীয় পার্টির কার্যালয় থেকেও বিক্ষোভ মিছিল বের করে জাতীয় ছাত্রসমাজ মহানগর কমিটি। পায়রা চত্বর ও জাহাজ কোম্পানি মোড় ঘুরে মিছিলটি আবার দলীয় কার্যালয়ে ফিরে আসে। উপস্থিত ছিলেন মহানগরের নেতৃবৃন্দ।

অন্যদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব আখতার হোসেন–এর নেতৃত্বে কাউনিয়া উপজেলার বেইলি ব্রিজ এলাকায় তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। একই শহরে, ভিন্ন ভিন্ন পথ—কিন্তু দাবি একটাই: বিচার।

ঘটনার পেছনের রেখাচিত্র

ঘটনার সূত্রপাত ১২ ডিসেম্বর। মতিঝিলে নির্বাচনী প্রচারণা শেষে ফেরার পথে পল্টন বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী দুষ্কৃতকারীরা ওসমান হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা চলে। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। সেখানেই দীর্ঘ লড়াই শেষে তাঁর মৃত্যু হয়।

শোকের কর্মসূচি

হাদির স্মরণে শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) বিকেল তিনটায় রংপুরে শোক র‍্যালি ও গায়েবানা জানাজার আয়োজন করা হয়েছে। টাউন হল চত্বর থেকে প্রেসক্লাব চত্বর পর্যন্ত র‍্যালি অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে, বাদ জুমা সর্বদলীয় ছাত্র-জনতার ব্যানারে মডেল মসজিদ চত্বর থেকে বিক্ষোভ মিছিল হওয়ার কথা রয়েছে।

রংপুরের এই রাত কেবল একটি বিক্ষোভের নয়—এটি এক প্রশ্নের রাত। বিচার কি কেবল স্লোগানে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে খুনিরা? হাদির মৃত্যু কি আরেকটি পরিসংখ্যান হয়ে যাবে, নাকি রাষ্ট্রকে তার দায় স্মরণ করিয়ে দেবে?
শহর ঘুমোতে যায়, কিন্তু প্রশ্ন জেগে থাকে। শীতের কুয়াশায় ঢাকা রংপুরে সেই প্রশ্নই ভাসে—বিচার হবে তো?

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code