১৭ই এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৪ঠা বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৯শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

লংগদুতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে ‘ আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার ও বিতর্কের সৃষ্টি

Sheikh Titumir
প্রকাশিত এপ্রিল ৩, ২০২৫, ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ
লংগদুতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে ‘ আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার ও বিতর্কের সৃষ্টি

মোঃ এরশাদ আলী, লংগদু প্রতিনিধি::

রাঙ্গসমাটি পার্বত্য জেলার লংগদু উপজেলাধীন ১নং আটারকছড়া ইউনিয়নে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের সাইনবোর্ডে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার: গভীর ষড়যন্ত্রের দেখা দিয়েছে।

পাহাড়ের জেলা রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার বামে আটারকছড়া এলাকায় ১৯৩৬ সালে আটারকছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি। বেশ কয়েক বছর আগে স্কুলেটিতে একটি ছাত্রাবাস চালু করা হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ । কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রাবাসটির নামকরণ করা হয়েছে ‘আদিবাসী’ আবাসিক ছাত্রাবাস (হোস্টেল ভবন)’। এই নামকরণে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহারে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে নানা বিতর্ক ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এলাকার সচেতন মহল মনে করছেন, পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কোন গ্রুপের উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ‘আদিবাসী’ শব্দের প্রচলন তৈরি, এর সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায় ও দেশের সার্বভৌমত্বকে দ্বিখণ্ডিত করার গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখছেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের কোথাও ‘আদিবাসী’ শব্দটির কোনো স্বীকৃতি নেই। সংবিধানের ২৩ (ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্র উপজাতি, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, নৃ-গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি রক্ষা ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এতে ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি; বরং ‘উপজাতি’ বা ‘ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী’র মতো শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যাতে স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে যে,বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আদিবাসী’ শব্দটিকে এড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনেও ‘আদিবাসী’ শব্দের পরিবর্তে ‘উপজাতি জনগোষ্ঠী’র মতো শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। পার্বত্য চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে ‘উপজাতীয় জনগণ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং তাদের অধিকার ও সংস্কৃতি রক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থার কথা বলা হয়। এখানেও ‘আদিবাসী’ শব্দটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়াও, সরকার বিভিন্ন সময়ে পরিপত্রে স্পষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন যে, ‘আদিবাসী’ শব্দটি গণমাধ্যম টকশো, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও সরকারি নথিপত্র বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ বামেছড়া এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের সাইনবোর্ডের নাম মুছে দিয়ে ‘ আদিবাসী ছাত্রাবাস’ (হোস্টেল) নাম করণ জনমনে বিতর্ক, বিক্ষোভ তৈরি করেছে। যা রাষ্ট্রের আইন ও সংবিধানকে অবজ্ঞা এবং স্পষ্ট দেশদ্রোহীতার শামিল। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম করণে সরকারি নীতিমালা ও আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। প্রশ্ন উঠছে—এই নামকরণের প্রস্তাব কে দিয়েছিল? কারা এটি অনুমোদন করেছে? এবং কেন সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষিত হলো? এসব রাস্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না কেন? প্রশাসন কি এসবের দায় এড়াতে পারবেন?

উল্লখ্য, ২০০৭ সালে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ঘোষণাপত্রে ‘আদিবাসী’ শব্দটির ব্যবহার পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এই অঞ্চলের কিছু গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের ধারণা, এটি তাদের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ। তাদের এই দাবির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের যুক্তি, বাংলাদেশের সব নাগরিকের আলাদা মর্যাদা নির্ধারিত। জাতি হিসেবে ‘বাঙালি’—এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে ‘উপজাতি’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদেশে উপজাতি জনগোষ্ঠীর বসবাসের ইতিহাস প্রাচীন নয়। আদিবাসী সংজ্ঞা অনুযায়ী উপজাতিরা এদেশের আদি বাসিন্দা কিংবা আদিবাসী নয়। এখানে বাংলাদেশ সরকার তাদের দাবি মেনে নেয়নি।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের
ছাত্রাবাসের নামে ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করাকে অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছেন। এটি হয়তো একটি প্রতীকী পদক্ষেপ, যার মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘আদিবাসী’ পরিচয়কে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এতে অত্রাঞ্চলের পাগাড়ি-বাঙ্গালীর মধ্যে পরস্পর সামাজিক বন্ধন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা ও জাতীয় ঐক্যের প্রতও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার ঘটতে পারে।

স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে যোগাযোগ করলে মুঠোফোনে জানান, পরিপত্র অনুযায়ী সাইনবোর্ডে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আবাসিক ছাত্রাবাস লেখা হয়েছে। কে বা কারা সাইনবোর্ড মুছে “আদিবাসী ” নাম করণ করেছে। তিনি জেলা সদরে রয়েছেন বলে জানান।

সরকারি প্রতিষ্ঠানের নাম করণে ” আদিবাসী ” প্রতিস্থাপন করার চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিতর্ক ও স্থানীয় প্রতিক্রিয়ায় ইউপি চেয়ারম্যান “আদিবাসী” শব্দটি মুছে দিয়েছেন। এখানে অনেকের দাবি সরকারি প্রতিষ্ঠানে সাইনবোর্ডে আদিবাসী শব্দের ব্যবহার না করে নিরপেক্ষ নাম করণ করা হউক।

Sharing is caring!