পার্বতীপুরে শিক্ষকের কটুক্তি অভিযোগে উত্তেজনা: নীরব প্রশাসন, আতঙ্কে গ্রাম
লোকমান ফারুক, বিশেষ প্রতিনিধি,:- দিনাজপুরের পার্বতীপুরের হাবড়া ইউনিয়নের বড় মরনাই গ্রামের বাতাসে এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে অবিশ্বাস ও ক্ষোভের গন্ধ। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাদামাটা ভবনটিকে ঘিরে যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে, তা কেবল একটি কথার সূত্রে। কথাটি নাকি উচ্চারণ করেছিলেন সহকারী শিক্ষক দীপু রায় (৩৬)—ক্লাসে, শিক্ষার্থীদের সামনে।
ঘটনাটা ঘটেছে কয়েক দিন আগে। বিদ্যালয়ের এক শ্রেণিকক্ষে তখন ধর্ম ও সৃষ্টিকর্তা প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল। শিক্ষার্থীদের কেউ প্রশ্ন করেছিল—’স্যার, আল্লাহ কাকে বলে?’ প্রত্যক্ষদর্শী এক শিক্ষার্থী পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘স্যার তখন বলেন, ইসলাম ধর্মে আল্লাহ বলে কিছু নাই। মক্কা-মদিনায়ও নাকি মূর্তি আছে, মুসলমানরা জানে না।’
বাচ্চারা হতবাক! বাড়ি ফিরে ঘটনা খুলে বলে। মুহূর্তেই গ্রামজুড়ে আগুন লাগে ক্ষোভের। পরদিন সকালেই বিদ্যালয়ের গেটে জড়ো হন অভিভাবক ও স্থানীয় মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা। হাতে হাতপাখা, গলায় রাগে কাঁপা স্লোগান—’ধর্ম অবমাননা চলবে না!’ পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত, তখন পাশের কয়েকটি স্কুলের শিক্ষকরা এসে বোঝানোর চেষ্টা করেন। পুলিশও খবর পেয়ে আসে, থমথমে হয়ে যায় বাতাস।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—ঘটনার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেই। হাবড়া ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, ‘শিক্ষক যদি এমন কথা বলেন, তাহলে বাচ্চারা কী শিখবে? আমরা তার শান্তি চাই, কিন্তু ন্যায়বিচারও চাই।’
অভিযুক্ত শিক্ষক দীপু রায় অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সংক্ষেপে বলেন, ‘আমি কিছু বলিনি। আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে।’ তবে বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ঘটনাটি পুরোপুরি অস্বীকার করা যাচ্ছে না। কেউ কেউ ইঙ্গিত করেছেন, দীপু রায়ের অতীতে ধর্মীয় বিষয়ে ‘উস্কানিমূলক’ মন্তব্যের নজির আছে।
এদিকে শিক্ষা বিভাগের নীরবতা এখন জনরোষের নতুন লক্ষ্য। শেরপুর ভবনীপুর ক্লাস্টারের দায়িত্বে থাকা সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হাসেম আলী সাংবাদিকদের বলেন,’বিষয়টি শুনেছি, তবে তদন্ত ছাড়া কিছু বলা যাবে না।’
প্রশ্ন ছিল—তদন্ত কবে শুরু হচ্ছে? উত্তর আসেনি।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এনামুল হক সরকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,’অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তবে তাঁর কণ্ঠে ছিল দ্বিধা, যেন প্রশাসনের কোনো অদৃশ্য পর্দা তাঁকে বেঁধে রেখেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদ্দাম হোসেন বলেন,
‘আমি শুনেই নির্দেশ দিয়েছি ব্যবস্থা নিতে। বিষয়টি অগ্রগতির পর্যায়ে।’ কিন্তু সেই ‘অগ্রগতি’ ঠিক কোথায়—তা কেউ জানে না।
পার্বতীপুর মডেল থানার ওসি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন,’এখনও পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
একটি গ্রাম, একটি স্কুল, আর একটি কথার ভুলে—ভয়, রাগ, আর ধর্মীয় সংবেদনশীলতার আগুনে এখন দগ্ধ হাবড়া ইউনিয়ন।
সন্ধ্যায় স্কুলের সামনে দাঁড়ালে দেখা যায়, বাতাসে এখনো অস্বস্তির গন্ধ। শিশুরা দূর থেকে তাকায় সেই ক্লাসরুমের দিকে—যেখানে কথাগুলো নাকি বলা হয়েছিল। অভিভাবকরা সন্তানদের হাত শক্ত করে ধরে রাখে, যেন কোনো অদৃশ্য ভয় ছায়া ফেলে দিয়েছে গ্রামে।
প্রশাসনের ধীর পদক্ষেপে প্রশ্ন জেগেছে—’কেন এত নীরবতা?’এটি কি আইনের শ্লথতা, নাকি প্রভাবের রাজনীতি?
ঘটনার পর কয়েকদিন কেটে গেছে। স্কুলের মাঠে এখনো খেলা করে বাচ্চারা, কিন্তু বড় মরনাইয়ের বাতাসে ঝুলে আছে এক অজানা অস্থিরতা। সেই অস্থিরতার নাম—অপেক্ষা, কখন সত্য প্রকাশ পাবে, আর কখন একজন শিক্ষকের কথার দায় নেবে ন্যায়বিচার।
Sharing is caring!