মোঃ রায়হান হোসেন: টাকা মিলবে কাঁড়ি কাঁড়ি যদি ছাড়েন চিনির গাড়ি। আসলে কথাটা শুনে হয়তো যে কেউ চমকে উঠতে পারেন তবে পিছনে রয়েছে অজানা বহু গল্প। সিলেট সীমান্তে যখন চোরাই চিনির রমরমা কারবার, তখন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের (এসএমপি) দক্ষিণ বিভাগের একটি থানা এলাকায় শুরু হয়েছে চোরাই চিনির গাড়ি (ট্রাক, মিনি ট্রাক) ছাড় দেওয়ার আরেক কারবার।
প্রশাসনের এমন কর্মকার্ডে চিনি চোরাচালান কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না। সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিনই বিপুল অর্থের ভারতীয় চোরাই চিনি ঢুকছে অবাধে। চিনি চোরাচালানে রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি শাহপরান (রহ.) থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনির হোসেনের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। চোরাকারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চোরাই চিনির গাড়ি ছাড় দিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামানোর অভিযোগের তীর বহুদিনের ওসি মনির হোসেনের দিকে। গত (৫ আগষ্ট) আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর থেকে চলতি নভেম্বর মাস পর্যন্ত চলছে গাড়ি ছাড়ের এই মহোৎসব।
অভিযোগ রয়েছে, শাহপরান (রহ.) মাজার পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক ভারপ্রাপ্ত আইসি মিজানুর রহমানের যোগসাজশে এ সুবিধাকে পুঁজি করে চোরাই চিনির গাড়ি ছাড় দিয়ে নগরী পাড় করে দেওয়ার কাজটি ওসি মনির হোসেনের অধীনস্থদের মধ্যে তার গাড়ি চালক শফিককে দিয়েই তিনি বহুদিন ধরে একাই নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কথায় আছে না ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’। একপর্যায়ে শাহপরান (রহ.) মাজার পুলিশ ফাঁড়ির আইসি হিসেবে যোগদান করেন এসআই সানাউল ইসলাম। তিনি একজন সৎ ও নামাজি এমনকি ঘুষ নেওয়াত বহুদূর এবিষয়ে কথা বলা কিংবা শুনতেও অনিচ্ছুক তিনি যা তার অজান্তেই দফায় দফায় প্রতিবেদকের পরীক্ষার মারফতে এমনটি উঠে আসে।
শাহপরান (রহ.) মাজার পুলিশ ফাঁড়ির আইসি হিসেবে যোগদান করেই সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের সুযোগ্য কমিশনার মো. রেজাউল করিম (পিপিএম-সেবা) এর সার্বিক সহযোগিতায় এসআই সানাউল ইসলাম ধরতে শুরু করেন তামাবিল মহাসড়ক হয়ে সিলেটগামী আসা ভারতীয় চিনি ভর্তি অসংখ্য ট্রাক ও এসব বহনের কাজে ব্যবহৃত চালক ও হেলপারকে। মূলত আইসি সানাউল ইসলামের ধারাবাহিক চিনি আটকের ঘটনায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ভাবমূর্তি সাধারণ মানুষের নিকট রক্ষা হতে চলছে পাশাপাশি সুনামও কুড়াচ্ছে শাহপরান (রহ.) থানা পুলিশ। অদৃশ্য কোন কারণে আইসি হিসেবে সানাউল ইসলাম যোগদানের পূর্বে ওসি মনির হোসেনের পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব হয়নি চিনির গাড়ি আটক কিংবা মামলা দেওয়া। উল্টো আইসি সানাউল ইসলাম এসব চোরাই চিনির ট্রাক আটক করতেন সে গাড়িতে থাকা মালের মূল মালিকের নাম মামলায় আসামি করতে চাইলে ওসি মনির হোসেন এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যেতেন শেষমেশ নিরুপায় হয়ে আইসি সানাউল ইসলাম ওসির কথামতোই এজার প্রস্তুত করতে বাধ্য হতেন। এক কথায় তামাবিল মহাসড়কের চিনি চোরাকারবারিদের গলার কাঁটা আইসি সানাউল ইসলাম।
নাম প্রকাশে থানা পুলিশের একাধিক বিশস্ত সুত্রমতে, ওসি মনির হোসেন চিনির গাড়ি না ধরার জন্য বিভিন্ন মারফতে আইসি সানাউল ইসলামকে বদলির ভয়ভীতি সহ নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করতেন। এতেও কাজ হয়নি আইসি সানাউল ইসলাম নিজের নীতি ও আর্দশকে বিন্দুমাত্র কলুষিত করতে অনিচ্ছুক।
গত শনিবার (৯ নভেম্বর) আইসি সানাউল ইসলাম সহ পুলিশের একটি টিম চোরাই চিনি আসছে মর্মে খবর পেয়ে সুরমাগেইট বাইপাস এলাকায় অভিযান পরিচালনা করার সময় ওসি মনির হোসেনের পরামর্শক্রমে আইসি সানাউল ইসলাম ভেবে ফাঁড়িতে যোগদানকৃত এক নতুন কনেস্টবলকে প্রাইভেট কারযোগে জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে যায় চোরাকারবারি দলের কয়েকজন। এমনকি তাকে আইসি সানাউল ইসলাম ভেবে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে চড়-থাপ্পড়ও মারে। পরবর্তীতে সে একজন কনেস্টবল জানালে প্রাণে রক্ষা হয় তার। এদিকে পিছনে ধাওয়া করে মোগলাবাজার থানাধীন এলাকা থেকে এ কনেস্টবলকে উদ্ধার করেন আইসি সানাউল ইসলাম সহ পুলিশের টিম। কিন্তু ওসি মনির চোরাকারবারিদের রক্ষার কবজ হওয়াতে আহত ওই কনস্টেবলকে জানান এসব বিষয় জানাজানি হলে থানা পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে বলে তিনি ঘটনাটি ধামাচাপা দিয়েছেন মর্মে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একটি সুত্র জানায়। তাহলে অবৈধভাবে কালো টাকা রুজি করাই কি শাহপরান (রহ.) থানার ওসি মনির হোসেন ও আইসি সানাউল ইসলামের দ্বন্দ্বের মূল কারণ?
এছাড়াও প্রতিবেদকে পুলিশের আরেকটি সুত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার (০৭ নভেম্বর) দুপুরে হরিপুরের শীর্ষ চোরাকারবারি ৫নং ফতেপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি রুবেল শরীফ উরফে তেলচুরা রুবেলের ভারতীয় কাপড় ও কসমেটিক ভর্তি ৪টি গাড়ি ঢাকায় যাওয়ার উদ্দেশ্য ঘাটেরছটি নামক স্থানে দাঁড়িয়ে আছে তবে এ বিষয়টি আইসি সানাউল ইসলাম এর নলেজে ছিল। কিন্তু চোর শুনে না ধর্মের কাহিনী।
সুত্রমতে, ওসি মনির হোসেন তার গাড়ি চালক শফিকের মারফতে এমন সংবাদ পেয়ে কৌশলে আইসি সানাউল ইসলামকে ওয়াকিটকির মাধ্যমে ডেকে থানায় নিয়ে যান এবং বিভিন্ন অজুহাতে সময় কালযাপন করে ওই ৪টি গাড়িকে যাতায়াতের সুবিধা করে দেন। বিনিময়ে ৪টি গাড়ি হইতে ২ লাখ টাকা ওসি মনির হোসেন উৎকোচ হিসেবে চালক শফিক এর মাধ্যমে গ্রহণ করেন।
প্রশাসনিক অন্য একটি সংস্থার সুত্রমতে- ওসি মনির হোসেনের কথা অমান্য করে তার গাড়ি চালক শফিক মিয়ার সাথে কন্ট্রাকের মধ্যে কয়টি গাড়ি আইসি সানাউল ইসলামের আদেশক্রমে ধরে ফেলায় ওসি মনির হোসেন ক্ষিপ্ত হয়ে নিজের আখের গুছাতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. রেজাউল করিমকে (পিপিএম-সেবা) ভুল বুঝিয়ে গত ২৩/১০/২০২৪ইং তারিখে কমিশনার আদেশ নং- ২৩৭৯ মূলে শাহপরান (রহ.) মাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই, এএসআই, এটিএসআই ও কনেস্টবল সহ একযোগে ১৯জন পুলিশ সদস্যকে বদলি করিয়েছেন। যা সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের ইতিহাসের পাতায় স্মৃতি হয়ে থাকবে।
উল্লেখ্য, ওসি মনির হোসেনের কথার অবাধ্য হয়ে একাধিক চোরাই চিনির গাড়ি আটক করার ফলসরূপ শাহপরান (রহ.) মাজার পুলিশ ফাঁড়িতে আইসি হিসেবে খুব একটা বেশিদিন থাকতে পারেন নি এসআই আব্দুল আজিজ। এক পর্যায়ে এক কনেস্টবলকে দিয়ে কৌশলে কমিশনার বরাবরে আইসি আব্দুল আজিজের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করান ওসি নেপথ্যে থেকে। কিন্তু কমিশনার ওসি মনির হোসেনের এ চক্রান্ত বুঝতে না পেরে এসআই আব্দুল আজিজকে বদলি করেন। কথা হচ্ছে এসআই আব্দুল আজিজ আর সানাউল ইসলাম বড় বিষয় না। এ ফাঁড়িতে আইসি হিসেবে যে কেউই চাকুরী করতে হলে ওসি মনির হোসেনের অনৈতিক সকল কর্মকান্ড মেনেই চলতে হবে নতুবা তার জন্য শেষ পরিনাম হবে খুব ভয়াবহ।
শাহপরান (রহ.) থানা এলাকার সঙ্গে সিলেটের সীমান্ত এলাকা- জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও কানাইঘাটের রয়েছে সহজ সড়ক যোগাযোগ। চোরাই চিনির গাড়ি সরাসরি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে পৌঁছাতে এসএমপির দক্ষিণের এ থানা অতিক্রম করতে হয়। এ সুবিধাকে পুঁজি করে চোরাই চিনির গাড়ি ছাড় দিয়ে নগরী পাড় করে দেওয়ার কাজটি ওসি মনির হোসেনের অধীনস্থ চালক শফিককে দিয়ে তিনি একাই নিয়ন্ত্রণ করছেন যা চালক শফিক ও ওসি মনির হোসেনের ব্যক্তিগত ফোন নাম্বারসহ তাদের এ নাম্বারে ব্যবহৃত হোয়াটসঅ্যাপ অনুসন্ধান করলে বেড়িয়ে আসবে তলের বিড়াল বলে একাধিক পুলিশের সুত্র নিশ্চিত করেছে।
এ বিষয়ে শাহপরান (রহ.) থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ মনির হোসেন এর ব্যবহৃত সরকারি সেলফোনে যোগাযোগ করলে তিনি ফোনকল রিসিভ না করায় বক্তব্য সংগ্রহ করা যায়নি।