‘শোনা গেল লাশ কাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে
কাল রাতের ফাগুনের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।’
(আট বছর আগে একদিন- জীবনানন্দ দাশ)
রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ যার ডাক নাম ছিল মিলু। জীবনানন্দ দাশ আজো এক বিপন্ন বিস্ময়ের নাম। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ৯ মে যে যৌথজীবনের শুরু হয়েছিল তার সমাপ্তি হয় ১৯৫৪ সালের ২২ অক্টোবর কলকাতার শম্ভুনাথ প-িত হাসপাতালে জীবনানন্দের জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে। চব্বিশ বছরের দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন সময়ের নানা ঘটনার বিবরণ জানা যায় লাবণ্য দাশের ‘মানুষ জীবনানন্দ’ গ্রন্থে। জীবনানন্দ আর লাবণ্যের দম্পত্য জীবন যে সুখকর ছিল না এটা লাবণ্য দাশের লেখাতে বেশ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও আন্তরিক তথ্য উপস্থাপন করে ভূমেন্দ্র গুহ নিজেকে পরিচিত করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘লাবণ্য দাশ ছিলেন খুবই সুন্দরী মহিলা। নিজের রূপ-সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি সব সময় সচেতন থাকতেন। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ সবসময়ই তার স্ত্রীকে উপেক্ষা করতেন। লাবণ্য দাশ মহিলা হিসেবে অসাধারণ ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ উৎকৃষ্ট স্বামী ছিলেন না। উৎকৃষ্ট পিতাও ছিলেন না। কাব্য নিয়েই তার যত সাধনা, যত ধ্যান। কবিতার জন্যই সাহিত্যের জন্যই তিনি তিক্ত জীবনযাপন করে গেছেন। তিনি তার স্ত্রীকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে জীবনানন্দ দাশ সংসার চালাতে যে অক্ষম, এটা বোঝাতে তার স্ত্রী ভালোবাসতেন। কবি জীবনানন্দের বাইরে গিয়ে মানুষ তথা ব্যক্তি জীবনানন্দের যে ধারণা আমাদের কাছে আছে, সেখানে নতুন করে চিন্তার জায়গা তৈরি করবে তার স্ত্রীর লেখা বই। বাংলা কবিতার ‘নির্জনতম কবি’ আখ্যা পাওয়া কবিকে ভিন্নভাবে জানতেও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেবে লাবণ্য দাশ। লাবন্যকে বিয়ের পাত্রের সামনে হাজির করা হয় তার জেঠামশাইয়ের বাড়িতে। বাবা-মা ছাড়া আত্মীয়ের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা লাবণ্যর তাই বিয়ের পাত্র বাছাইয়ের সুযোগ ছিল না। একধরনের বাধ্য হয়েই কবিকে বিয়ে করতে হয়। জীবনানন্দের সঙ্গে লাবণ্য দাশের যখন বিয়ে হয় তখন জীবনানন্দ দিল্লির একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। অপরদিকে লাবণ্য তখন ঢাকা ইডেন কলেজের ছাত্রী। বিয়ের সময় লাবণ্য ও পরিবারের কেউ জীবনানন্দকে কবি হিসেবে জানতেন না। জীবনানন্দ এবং লাবণ্য দাশের পারস্পরিক স্বভাব ছিল উল্টো। স্বামীর সঙ্গে নিজের স্বভাবের তুলনা করে লাবণ্য বলেছেন- ‘স্বভাবে আমি চিরকাল কবির একেবারে উল্টো। তিনি ছিলেন ধীর, শান্ত। আর আমি ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতার ধার দিয়েও যাই না।’ ছোটবেলা থেকে বাবা-মা বঞ্চিত আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়ে ওঠা পাটনা, ঢাকার ইডেন ও পরে বরিশালে পড়াশোনা করা লাবণ্য ছিলেন বেশ রাজনৈতিক সচেতন।
কলকাতায় বসবাসের সময় জীবনানন্দ স্ত্রী লাবণ্য দাশকে অনেকটা স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। নিজের মতো করে কিছু করতে উৎসাহও জুগিয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪ সালের ১২ মার্চ লাবণ্য দাশ ‘চলোর্মি’ ক্লাব থেকে রঙমহলে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’-তে অভিনয় করেছিলেন। এটা নিয়ে অনেকে নানা কথা রটাতে শুরু করেছিল। তার জবাবে জীবনানন্দ বলেছিলেন- ‘আমি এখনো মরিনি। আমার স্ত্রী কী করবেন না করবেন, সে দায়িত্ব আমার ওপরে ছেড়ে দিলেই সুখী হব।’ এইভাবে নিজের রূপসী, সুন্দর-সচেতন স্ত্রীকে নিজের মতো থাকবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। জীবনানন্দ মারা যাওয়ার পরে তার ট্রাঙ্কভর্তি লেখার খাতা ও ডায়েরি আবিষ্কার হয়েছে সেটা দেখে আমরা জানতে পেরেছি নিজের লেখালেখি নিয়ে কতটা খুঁতখুঁতে ছিলেন কবি। নিখুঁত ছন্দ, শব্দের জন্য তার প্রচেষ্টা আমরা কেবল অনুমানই করতে পারি। ব্যক্তি জীবনের এই দিকটির কথাও উল্লেখ করেছেন কবিপতœী ‘পরীক্ষা দিতে যাবার সময় আমার ছেলেমেয়ে অথবা আমি কেউই কোনোদিন পেন্সিল কেটে নিয়েছি অথবা কালি ভরেছি বলে তো মনে পড়ে না। এসব কাজ কবি নিজেই করতেন। তাঁর কাজ ছিল নিখুঁত।’ আমরা যাকে নির্জনতম কবি, অন্তর্মুখী মানুষ বলে অভিহিত করে আসছি তার চরিত্রেও ছিল হাস্যকৌতুক প্রিয়তা। ছিলেন গম্ভীর প্রকৃতির। কিন্তু সেই গাম্ভীর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকত তাঁর কৌতুকপ্রিয়তা। উপরে গাম্ভীর্যের একটা আবরণ থাকাতে তাঁর ঠাট্টা-তামাশা লোকে চট্ করে ধরতে পারত না। সেটা বলা যাবে না। এসব নিয়ে সংসারে মান-অভিমান ছিল ঢের। এসব ক্ষেত্রে কবির জেদি মনের প্রকাশ পাওয়া যেত।
জীবনানন্দের কবি জীবন নিয়ে লাবণ্য দাশের উপেক্ষা ও অনুযোগের কমতি ছিল না। সমাজের আর দশজন গৃহিণীর মতো একজন সাধারণ গৃহিণী হিসেবে তার ইচ্ছে ছিল সুখী সংসারের। যেখানে অভাব অনটন থাকবে না। তাই জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসাব মেলাতে চাওয়া লাবণ্য দাশ জীবনানন্দ মারা যাওয়ার পরে ভূমেন্দ্র গুহকে ডেকে বলেছিলেন- ‘বাংলা সাহিত্যের জন্য তিনি অনেক কিছু রেখে গেলেন হয়তো, আমার জন্য কী রেখে গেলেন বলো তো!’ এর মধ্য দিয়ে একজন স্বামীহীন স্ত্রীর অসহায় অবস্থার দিকটিই প্রকাশ পায়। জীবনানন্দ দাশের দাম্পত্য জীবন যে সুখের ছিল না তা জীবনানন্দ দাশের ভাতিজা অমিতানন্দের লেখা থেকে জানা যায়। আমিতানন্দের কথায়, বিয়ের কয়েক মাস আগে চাকরিটা ছেড়ে দিলেন হঠাৎ। তখন থেকেই দাম্পত্য জীবনের সংকট শুরু হয়। যা আর কখনো মেটেনি। অসুখী দাম্পত্য ফুটে উঠেছে তার লেখা একাধিক উপন্যাসেও। অমিতানন্দের খুঁজে পাওয়া একটি ডায়েরিতেও দেখা গেল সেই অস্থির জীবনের ছায়া। সেখানে এক জায়গায় লিখা আছে, ‘বাড়িতে থাকতে রোজই সন্ধ্যার পর ভাবতাম একটু অন্ধকারে থাকা যাক- জোৎস্না বা লম্ফের আলোতে - কিন্তু একটা না একটা কারণে রোজই আলো জ্বালতে হত- তারপর মেসে চলে গেলাম সেখানে roommate -দের জন্য আলোর ব্যবস্থা না হলে চলত না’ আবার আরেক জায়গায়, চিরদিন দুঃখভোগ করে যাওয়াটাই তো জীবনের উদ্দেশ্য নয় ....।’ নির্জনতার কবি জীবনানন্দ দাশের জীবন কেটেছে চরম দারিদ্র্য ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। পেশায় কলেজের শিক্ষক হয়েও কোথাও স্থির হতে পারেননি। জীবনের প্রয়োজনে ঘুরে বেড়িয়েছেন পাগলের মতো ।