দিলোয়ার হোসেন,বিশেষ প্রতিনিধি ::
সুনামগঞ্জের ছাতকে কোনো ভাবেই থামছেনা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলাসহ পাশ্ববর্তী সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের বেশ কয়েকটি মৌজার বনসহ ফসলি ভূমি। হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয় বনভুমি, ফসলি জমি, পরিবেশ ও এলাকার জীববৈচিত্র।
এসব বালু ও মাটি উত্তোলনে গেল দুই যুগ ধরে জড়িত রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এদের বাঁধা দিতে গিয়ে নদীর বালু খেকোদের হামলা থেকে বাদ পড়েননি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
জানা যায়, ছাতক ও কোম্পানিগঞ্জ নদীপথে চাঁদাবাজি ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ঘটনা ব্যাপক আলোচিত। কোম্পানিগঞ্জ সীমান্তে পিয়াইন নদীতে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে বালু উত্তোলেনের জন্য ইজারা থাকলেও ইজারাদার সরকারী নিয়ম নীতি তোয়াক্কা না করে অবৈধ ভাবে ড্রেজার দিয়ে রাতের আধারে বালু উত্তোলন করায় ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ।
এছাড়া কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ইজারাকৃত সীমানা অতিক্রম করে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলা সীমান্তে প্রবেশ করে অবৈধ ভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে আসছেন ইজারাদার সুজন মিয়া। তিনি কোম্পানীগঞ্জের চাটিবহর আমবাড়ি গ্রামের তৈমুছ আলীর ছেলে। মাঝে মধ্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে ড্রেজার, নৌকা বা শ্রমিক আটক হলেও পর্দার আড়ালে থেকে যাচ্ছেন সুজন মিয়ার মতো বালু খেকোরা। ইজারার নীতিমালায় সকাল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত দিনের আলোতে সনাতন পদ্দতিতে বালু উত্তোলনের কথা থাকলেও এখানে চলে দিন-রাত সমান তালে, তাও ড্রেজার দিয়ে। ইজারার নামে বৈধতার আড়ালেই নেওয়া হচ্ছে অবৈধ এমন সুযোগ সুবিধা। যে কারণে যুগ যুগ ধরে নদী পথে বন্ধ হচ্ছেনা এসব কর্মকান্ড। যা ২০১০ সালের মাটি ব্যবস্থাপনা আইনের সুস্পষ্ট লংঘন।
এসব বিষয় নিয়ে গত কয়েক বছর যাবত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর আক্রমন, গ্রুপে গ্রুপে মারামারি সহ নানা ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে সুরমা, পিয়াইন ও চেলা নদী। এছাড়াও রাতের অন্ধকারে টিলা কেটে পাথর চুরি, চাদাবাজিসহ নানা অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে এসব নদীগুলা। ২০২২-২৩ সালে গোয়ালগাঁও, ইসলামপুর, জামুরা ও গনেশপুর গ্রামের পিয়াইন নদী ও চেলা নদীতে অবাধে বোমা মেশিন ও ড্রেজার দিয়ে তাণ্ডব চালালে ইউনিয়নবাসী তীব্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে কয়েকটি নৌকা ও ড্রেজার মেশিন আটক করে ছাতক থানা পুলিশ। অবৈধ ড্রেজার মেশিন চালানোর অভিযোগে ওই সময়ে বালু মহাল ইজারাদার সুজন মিয়া ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়। এ মামলাটিও আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
এদিকে, নদীপথে চাদাবাজী ও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে গেল ৭ জুলাই একটি সংবাদ সম্মেলন করেন ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এডভোকেট সুফি আলম সোহেল। নদীর বালু খেকো চক্রের ডন নামে পরিচিত সুজন মিয়াসহ তার সহযোগিদের নানা অপরাধের চিত্র তুলে ধরা হয় ওই সংবাদ সম্মেলনে।
এসব অপরাধ ঢাকতে পরদিন অর্থাৎ ৮ জুলাই সন্ধ্যায় ছাতক পৌরশহরে নিজ অফিসে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন সুজন মিয়া। সংবাদ সম্মেলনে সিলেট জেলা প্রশাসক থেকে কোম্পানিগঞ্জ সীমান্তের পিয়াইন নদী ইজারার বিষয় তুলে ধরলেও প্রতিরাতে ছাতক সীমান্তে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের বিষয় এড়িয়ে যান সুজন।
এছাড়া গেল ১৪ জুলাই কোম্পানীগঞ্জের জুয়েল মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে অপহরন করে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দেয় বালু খেকো সুজনের লালিত বাহিনির সদস্যরা।
এ ঘটনায় জুয়েলের মা রুজিনা আক্তার বাদী হয়ে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করলেও বালু খেকো সুজন মিয়ার চাঁপে ঘটনাটি ধামাচাঁপা পড়ে যায়। গেল ৫ আগষ্ট আওয়ামীলীগ সরকার পতন হলেও থেমে নেই সুজন বাহিনির আদিপত্য। এছাড়াও ইসলামপুর ইউনিয়নের বাইদ্দাবাড়ির খাল, চলিতারঢালা ও নৌশাদর বাগান এলাকায় ড্রেজার দিয়ে সন্ধ্যা থেকে সারা রাত চলে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন।
২০২১ সালে পিয়াইন নদী ও চেলা নদীতে অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনে বাঁধা দেয় ছাতক নৌ-পুলিশ। এ সময় বালু উত্তোলনকারীদের হামলায় আহত হন কয়েকজন নৌ-পুলিশের সদস্য। এ ঘটনায় পুলিশের দায়েরকৃত মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। বালু খেকোদের মামলা-হামলার ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে নারাজ এলাকার সাধারণ মানুষ।
এসব বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে একাধিক অভিযোগ দায়ের করা হলেও থামে নেই নদীর বুকে ড্রেজার চালানো বালুখেকোদের তাণ্ডব। অবৈধ এ কর্মকান্ড চালিয়ে কোটিপতি বনেছেন অনেকেই। এলাকায় লাটিয়াল বাহিনী গড়ে তুলেছেন বলে জানা গেছে।
এ ব্যাপারে ইসলামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট সুফি আলম সুহেল বলেন, বালু মহাল ইজারাদার সুজন মিয়া আওয়ামীলীগের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছেন। তার এই সিন্ডিকেটে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় কয়েকজন জড়িত রয়েছেন। এলাকার ফসলি জমি, পরিবেশ ও এলাকার জীববৈচিত্র অবৈধ ভাবে বালু ও মাটি উত্তোলন বন্ধ করা একান্ত জরুরী।
এ ব্যাপারে ছাতক বালু ব্যবসায়ী সংগঠনের সভাপতি আবদুস ছাত্তার ও সাধারন সম্পাদক দিলোয়ার হোসেন বলেন, এখানকার পিয়াইন নদী বালু মহাল ছাড়াও একটি প্রভাবশালী চক্র অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন তাণ্ডব চালাচ্ছে। এবিষয়ে জরুরী ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন।
এ ব্যাপারে অবৈধ বালু উত্তোলনের বিষয়ে অভিযুক্ত সুজন মিয়ার সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করেও তাকে খোঁজে পাওয়া যায় না। ছাতক শহরে তার ব্যবসায়িক অফিস থাকলেও সেটির দরজায় তালা ঝুলছে। মুটোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে না পাওয়ায় কোন মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে ছাতক থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম কিবরিয়া হাসান বলেন, পিয়াইন নদী বালু মহাল ইজারা সুজন মিয়ার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। ট্রাস্ক ফোর্সের মাধ্যমে এসব অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবু নাসের বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলনের বিষয়টি জানার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে বেশ কয়েকবার ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা ও বল্কহেড আটক করা হয়েছে। এবিষয়ে ইজারা নিয়মনীতি ভঙ্গ করায় এটি বাতিল করতে প্রায় একমাস পূর্বে জেলা প্রশাসক বরাবরে একটি সুপারিশ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. ইলিয়াছ মিয়া বলেন, ইজারা বাতিলের বিষয়ে এক সভায় আলোচনা করা হয়েছে। তাকে ছাতকের এসিল্যান্ডও বাতিলের ব্যাপারে একটি লিখিত সুপারিশ করেছেন। এবিষয়ে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।