লোকমান ফারুক, রংপুর
ভোরের কুয়াশা তখনও জমে আছে পাটগ্রাম সীমান্তে। আলো–আঁধারির সেই অস্পষ্ট রেখায় কাঁটাতারের দুই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাহারারত চোখগুলো ঠিক করে বুঝে উঠতে পারছিল না—কে কোথায়। সীমান্ত মানেই যেখানে প্রতিটি পা মাপা, প্রতিটি গজ হিসাবি, সেখানে এক মুহূর্তের বিভ্রান্তিই বদলে দিতে পারে ঘটনাপ্রবাহ।
সেই কুয়াশার ভেতর দিয়েই ভোর পাঁচটার দিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার ১৭৪ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের সদস্য বেদ প্রকাশ এগিয়ে আসেন—প্রায় ১০০ গজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। দহগ্রাম ইউনিয়নের নীরব ভোর ভেঙে যায় ৫১ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ব্যাটালিয়নের টহল দলের সতর্ক উপস্থিতিতে। অনুপ্রবেশের অভিযোগে তাঁকে আটক করা হয়। মুহূর্তেই একটি সীমান্তঘটনা রূপ নেয় কূটনৈতিক পরীক্ষায়।
বিজিবি সূত্র জানায়, আটক বিএসএফ সদস্যের কাছ থেকে একটি শটগান, দুটি গুলি, একটি ওয়্যারলেস সেট এবং একটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। সীমান্তে যেখানে প্রতিটি অস্ত্র কেবল শক্তির প্রতীক নয়, বরং আস্থার ভারসাম্য, সেখানে এই জব্দকরণ ছিল প্রটোকল ও পেশাদারিত্বের অংশ। ঘটনার পরপরই বিএসএফকে পতাকা বৈঠকের জন্য আহ্বান জানায় বিজিবি—সংঘাত নয়, আলোচনার পথেই হাঁটার বার্তা।
রোববার বিকেলে তিনবিঘা করিডর এলাকায় বসে সেই পতাকা বৈঠক। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অন্তত ১০ জন করে সদস্য নীরব সাক্ষী। বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন ৫১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল সেলিম আল দীন। ভারতের পক্ষে ছিলেন ১৭৪ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক বিজয় প্রকাশ সুকলা। কাঁটাতারের দুই পাশের অভিজ্ঞ কণ্ঠগুলো সেখানে কথা বলেছে সংযত ভাষায়, হিসেবি শব্দে।
বৈঠক সূত্র জানায়, বিএসএফের পক্ষ থেকে অনুপ্রবেশের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হয় এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর ঘটবে না—এই আশ্বাস দেওয়া হয়। একই সঙ্গে সীমান্তে কোনো বাংলাদেশি নাগরিক ভারতে প্রবেশ করলে তাকেও আটক করে বিজিবির কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে উভয় পক্ষ একমত হয়।
কাগজে–কলমে এটি একটি সমঝোতা; বাস্তবে এটি সীমান্ত ব্যবস্থাপনার নৈতিক বোঝাপড়া।
লে. কর্নেল সেলিম আল দীন জানান, আটক বিএসএফ সদস্য বেদ প্রকাশ স্বীকার করেছেন—কুয়াশার কারণে গরু পাচারকারীদের ধাওয়া করতে গিয়ে তিনি ভুলবশত বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করেন। এই বক্তব্যে একদিকে আছে মানবিক ভুলের স্বীকারোক্তি, অন্যদিকে শীত মৌসুমে সীমান্তজুড়ে চোরাচালানের বাস্তবতা। ফলে উভয় বাহিনীই শীতকালে টহল জোরদারের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে।
অস্ত্র ও সরঞ্জামসহ বিএসএফ সদস্যকে শেষ পর্যন্ত পতাকা বৈঠকের মাধ্যমেই ফেরত দেওয়া হয়। দৃশ্যত এটি একটি শান্তিপূর্ণ সমাপ্তি। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—সীমান্ত কি শুধু কাঁটাতার আর মানচিত্রের রেখা, নাকি এটি শীতের কুয়াশায় মানুষের ভুলেরও নাম? একটি ভুল পা যেখানে দুই দেশের সম্পর্কের ভারসাম্য নাড়িয়ে দিতে পারে, সেখানে সতর্কতার দায় কার?
সন্ধ্যার দিকে তিনবিঘার আকাশে কুয়াশা আবার নামতে শুরু করে। সীমান্ত ফের নিঃশব্দ। কিন্তু ভোরের সেই ১০০ গজ পথ মনে করিয়ে দেয়—সীমান্তে কখনোই ছোট ঘটনা বলে কিছু নেই। প্রতিটি ঘটনা একটি পরীক্ষার নাম, আর প্রতিটি সমাধান একটি বার্তা।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক -শেখ তিতুমীর আকাশ।
বার্তা প্রধান : মোঃ সেলিম উদ্দিন
ইমেইল: dailyswadhinbhasha@gmail.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। সকল স্বত্ব www.swadhinbhasha.com কর্তৃক সংরক্ষিত।