লোকমান ফারুক, রংপুর
জুমার নামাজ শেষে, রংপুর শহরের আকাশ তখনো ভারী। মসজিদের মাইকে ভেসে আসা মোনাজাতের শেষ 'আমিন'-এর সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে ভেসে ওঠে আরেকটি শব্দ—ক্ষোভের। গুলিতে নিহত ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী, বিপ্লবী জুলাইযোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির নাম উচ্চারিত হতে না হতেই শহর যেন নীরবতা ভেঙে জেগে ওঠে।
শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে রংপুরে বের হয় শোক র্যালি, বিক্ষোভ মিছিল ও সর্বদলীয় প্রতিবাদ সমাবেশ। এটি কেবল একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়—এ ছিল রক্তের দাগ মুছতে না পারা এক জনপদের আর্ত উচ্চারণ।
নামাজ শেষে ওসমান হাদির রুহের মাগফিরাত কামনায় নগরীর বিভিন্ন মসজিদে দোয়া-মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। এরপর রংপুর মডেল মসজিদ চত্বর থেকে শুরু হয় বিক্ষোভ মিছিল। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা একে একে মিছিলে যোগ দেন—কারও চোখে অশ্রু, কারও কণ্ঠে বজ্র।
মিছিলটি নগরীর প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে গিয়ে থামে জুলাই স্মৃতিসৌধ চত্বরে। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় সর্বদলীয় প্রতিবাদ সমাবেশ। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে এলাকা—'ভারতের আগ্রাসন, রুখে দাও জনগণ,'
'আওয়ামী লীগের দালালেরা, হুঁশিয়ার সাবধান,'
'লাল জুলাইয়ের হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার,'
'আমরা সবাই হাদি হব, গুলির মুখে কথা ক’ব।'
সমাবেশে বক্তব্য দেন গণঅধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদের সদস্য হানিফ খান সজিব, জাতীয় ছাত্রশক্তি রংপুর জেলা আহ্বায়ক মুহিব, মহানগর আহ্বায়ক ইমতিয়াজ আহমেদ ইমতি, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের মহানগরের যুগ্ম আহ্বায়ক মুকিতুর রহমান মুকিত, কেন্দ্রীয় কার্যপরিষদ সদস্য ও মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি নুরুল হুদা, জাতীয় নাগরিক পার্টির জেলা আহ্বায়ক আল মামুন, বিএনপির মহানগর সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট মাহফুজ উন নবী ডন, জামায়াতে ইসলামীর মহানগর শাখার সহকারী সেক্রেটারি আল আমিন, গণসংহতি আন্দোলনের মহানগর আহ্বায়ক তৌহিদুর রহমান, ইসলামী ছাত্রশিবির নেতা গোলাম জাকারিয়া এবং বিএনপির মহানগর আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু।
বক্তব্যে বক্তারা এক প্রশ্নেই ফিরে যান বারবার—এই হত্যার পেছনে কারা? কার স্বার্থে রক্ত ঝরল? আর রাষ্ট্রের নীরবতা কি কেবলই কাকতাল? সমাবেশ শেষে নেতাকর্মীরা হাতে হাত রেখে আওয়ামী লীগের সব কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং ভারতীয় ষড়যন্ত্র কঠোরভাবে মোকাবিলার শপথ নেন।
রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু বলেন,"কারা এই হত্যার সঙ্গে জড়িত—আমরা শুধু ফ্যাসিস্টকে দেখি না, তার দোসরদেরও দেখি। তারা আবার মাথা তুলতে চাচ্ছে। কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।"
এরপর আবার শুরু হয় বিক্ষোভ মিছিল। জুলাই স্মৃতিসৌধ চত্বর থেকে কাচারি বাজার হয়ে জিলা স্কুলসংলগ্ন ডিসির মোড়ে গিয়ে মিছিল শেষ হয়। সেখানে উপস্থিত ছাত্র-জনতার দাবির মুখে ডিসির মোড়কে 'শহীদ শরিফ ওসমান হাদি চত্বর' ঘোষণা করেন সামসুজ্জামান সামু। তিনি বলেন, 'আজ যেভাবে আমরা একসঙ্গে দাঁড়িয়েছি, আগামীতেও ফ্যাসিস্টদের মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ থাকব।'
এর আগে, জুমার নামাজের পর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শরিফ ওসমান হাদির স্মরণে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন এবং জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া নেতাকর্মীরা অংশ নেন।
দিন শেষে রংপুর শহর আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরলেও প্রশ্ন থেকে যায়—একজন রাজনৈতিক কর্মী নিহত হন, শহর জ্বলে ওঠে, শপথ নেওয়া হয়; কিন্তু বিচার কি এগোয়? নাকি প্রতিবারের মতো রক্ত শুধু আরেকটি শিরোনাম হয়ে জমে থাকে আর্কাইভে?
জুলাই স্মৃতিসৌধের পাদদেশে তখনো বাতাসে ভাসছিল সেই উচ্চারণ—'আমরা সবাই হাদি হব।'
গুলির শব্দ থেমে গেছে। কিন্তু প্রতিধ্বনি এখনো রংপুরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক -শেখ তিতুমীর আকাশ।
বার্তা প্রধান : মোঃ সেলিম উদ্দিন
ইমেইল: dailyswadhinbhasha@gmail.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। সকল স্বত্ব www.swadhinbhasha.com কর্তৃক সংরক্ষিত।